বিনোদন

‘যত দিন যাচ্ছে তত অনৈক্যের সুর বাজছে’

রাহাত সাইফুল : বাংলাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর। গণসংগীত ও দেশীয় পপ সংগীতে তার ব্যাপক অবদান রয়েছে। ১৯৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। পাশাপাশি বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে গণসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন শব্দ সৈনিক হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন এ শিল্পী। এছাড়া তিনি রণাঙ্গনের সৈনিক হিসেবে ভাঙ্গা, শীবচর এলাকায় যুদ্ধও করেছেন।

 

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে নিয়মিত সংগীত পরিবেশনার পাশাপাশি প্রচলিত ও প্রথাসিদ্ধ গানের বন্ধ্যাভূমিতে দেশজ ও পাশ্চাত্য সংগীতের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা গানে নতুন মাত্রা সংযোজন করেন। মহান বিজয় দিবসকে সামনে রেখে এ শব্দ সৈনিকের সঙ্গে কথা বলেন রাইজিংবিডির এ প্রতিবেদক। এ আলাপচারিতার বিশেষ অংশ রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

 

রাইজিংবিডি : দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে একজন আপনি। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর আপনার অনুভূতি জানতে চাই?

ফকির আলমগীর : লাল সবুজের উৎসব করতে গিয়ে দুটি বেদনা আমাদের ব্যথিত করে, যেমন খুশির মাঝে জাগে ব্যথা। একটি হলো আমাদের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান পন্থীরা স্বপরিবারে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই। এটা যেমন আমাদের ব্যথিত করে, তেমনি বুদ্ধিজীবীরাও আজ আমাদের মাঝে নেই। এ দুটি বেদনা বিজয়ের আনন্দকে ম্লান করে। বিজয় আনন্দের, বিজয় উৎসবের। এছাড়া স্বাধীনতার মহান নায়করা যারা আমাদের মাঝে নেই তাদের বিয়োগ বেদনা আমাদের ব্যথিত করে।

 

রাইজিংবিডি : দেশের জন্য যে কারণে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেটা কতটা সফল হয়েছে বলে মনে করেন?

ফকির আলমগীর : যে কারণে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি সেটা সফল হয়েছে। একটা ভৌগলিক স্বাধীনতার দরকার ছিল, যা না হলে এদেশ উন্নত হতো না। আজকের এই উন্নয়ন-অগ্রগতির মহাসড়কে যেতে পারতাম না। এবারে ৪৫তম বিজয় দিবস পালন হচ্ছে এমন সময়, এমন প্রেক্ষাপটে, যে সময় আমাদের হলি আর্টিসান, নাসিমনগর, গাইবান্ধায় সাম্প্রদায়িক শক্তি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করছে। আমরা বলতে পারি ‘ঐক্য করো বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতার হবে শেষ’। অপশক্তি, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ নির্মূলে আমাদের হাতিয়ার ছিল জাতীয় ঐক্যজোট। যত দিন যাচ্ছে তত অনৈক্যের সুর বাজছে। এর ফলে স্বাধীনতা বিরোধীরা উৎসাহিত হচ্ছে। আমাদের অনৈক্যে তারা সুযোগ পাচ্ছে।

 

রাইজিংবিডি : দেশ আজ কতটা কলঙ্ক মুক্ত হয়েছে বলে মনে করছেন?

ফকির আলমগীর : জাতি আজ কলঙ্ক মুক্ত হচ্ছে। যুদ্ধঅপরাধীর বিচার শুরু হয়েছে। এখনো যাদের হয়নি ও বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামী, বুদ্ধিজীবী হত্যার আসামীদেরকেও ফাঁসি দিতে হবে। তবেই আমাদের দেশ কলঙ্ক মুক্ত হবে। বিজয় তখনই সত্যিকার অর্থে পালিত হবে।

 

রাইজিংবিডি : আমাদের স্বাধীনতা ও ইতিহাস নতুন প্রজন্ম কতটা সঠিকভাবে জানতে পারছে বলে মনে করছেন?

ফকির আলমগীর : স্বাধীনতা বিরোধীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। তখন আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। নতুন প্রজন্মের মাঝে ভুল ইতিহাস জানানো হয়েছে। তাদের পরাজিত করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের আবার পূণর্বাসন করা হচ্ছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের গেজেট প্রকাশ করে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। এগুলো অত্যান্ত শুভ উদ্যোগ।

 

রাইজিংবিডি : নতুন প্রজন্মের মাঝে স্বাধীনতার চেতনা কতটা আছে বলে মনে করছেন?

ফকির আলমগীর : নতুন প্রজন্মের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা অনেক বেশি। আমরা খুবই আশাবাদী। নতুন প্রজন্ম শুধু অপশক্তিকে শুধু রুখে দাঁড়ায়নি, শাহবাগ বসন্ত থেকে তেল গ্যাস আন্দোলনে তারা অনেক ভূমিকা রেখেছেন। বুড়োরা কিন্তু বিভ্রান্ত। হাইব্রিডের নেতৃত্বে বিপথগামী, বিভ্রান্তও, পলায়নপর। নতুনপ্রজন্ম খুবই প্রযুক্তি নির্ভর। তারা মিথ্যাকে মিথ্যা জানে আবার সত্যকে সত্য জানে।

 

রাইজিংবিডি : স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর আমাদের শিল্প সংস্কৃতির কতটা উন্নতি হয়েছে বলে মনে করছেন?

ফকির আলমগীর : কতটা উন্নতি হয়েছে সেটা বড় কথা নয়। শিল্প-সংস্কৃতির চর্চাই পারে অপসংস্কৃতিকে রুখে দাঁড়াতে। ৫২ থেকে ৭১ সালের আন্দোলনে আমাদের শিল্প সংস্কৃতির ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে আরো বেগবান করতে হবে। আরো বিশুদ্ধ করতে হবে।

 

রাইজিংবিডি : স্বাধীনতা যুদ্ধের কোনো স্মৃতি যা আজও আপনাকে সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।

ফকির আলমগীর : মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’ অজিত রায়ের পরিচালনায় সুজেয় শ্যামের সুরে, শহিদুল ইসলামের লেখায় গানটিতে আমরা কয়েকজন কন্ঠ দিয়েছিলাম। এ স্মৃতি আমাকে ৪৫ বছর পরও স্মরণ করিয়ে দেয়। পশ্চিম বাংলার মেদিনীপুরে গিয়েছিলাম আবদুল গাফফার চৌধুরীসহ আমরা কজন। সেখানে জনসভা হয়েছে, গান হয়েছে। শেষ গানটি আমি গেয়েছিলাম। গান গেয়ে যখন আমি মঞ্চ থেকে নামছি তখন খবর আসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই যে আনন্দের অনুভূতির কথা আজ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। কেবল শিহরিত হই। এমন অনুভূতি আর ফিরে আসবে না।

 

রাইজিংবিডি : রাইজিংবিডিকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ফকির আলমগীর : রাইজিংবিডিকেও ধন্যবাদ।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৬/রাহাত/মারুফ