বিনোদন

‘খুন্তি দিয়ে ছেলেটাকে মেরেছিলাম’

ফেরদৌস আরা : মেয়েদের কি কি নিষেধাজ্ঞা থাকে? এই যেমন উচ্চশব্দে কথা বলা যাবে না, পা ঘঁষে ঘঁষে হাঁটা যাবে না। গান গাওয়া যাবে না। আগে ভাগে খাওয়া যাবে না, ছেলেদের সাথে কোনো কিছু নিয়ে পাল্লা দেয়া যাবে না। আমি আসলে একেবারে গুণে গুণে এই কাজগুলোই করতাম। পয়লা বৈশাখে ঘুড়ি ওড়ানো, চাকা চালিয়ে পাল্লা দেওয়া, সঙ্গে মারামারি করাটাও ছিল রুটিন মাফিক কাজ। এই নিয়ে বাড়িতে নালিশ আসত। যেহেতু বাবার চাকরির সুবাদে বাড়িতে বেশি থাকা হতো না, সেই জন্য কিছুটা ছাড় এমনিতেই পেয়ে যেতাম। আমার বাবার বাড়ি নোয়াখালি। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বাবা আমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতেন। গ্রামে মেলা বসত। দলবেঁধে মেলায় যেতাম। ছোট সময় থেকেই আমার মাথায় অনেক চুল। আর তখন মেয়েদের সাজ মানে মূলত চুলের সাজ। লাল চওড়া ফিতা দিয়ে মা চুল বেঁধে দিতেন। চোখে কাজল দিয়ে দিতেন। মেলায় গিয়ে বিভিন্ন ধরণের মিষ্টি খাওয়া হতো। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসত। তাদের নতুন পোশাক দেওয়া হতো। আশেপাশের বাড়িতে খাবার পাঠানো হতো। বিশেষ করে মিষ্টি পাঠানো হতো। কোনো এক ফাঁকে কারো না কারো সাথে মারামারি লেগেই যেত। চুল-টুল; টেনে-টুনে এলোমেলো অবস্থায় শেষ পর্যন্ত বাড়িতে ফেরা। রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে প্লাস্টিকের বাঁশি বাজানো হতো। সেই সময়টা এখনো খুব মনে পড়ে। একটু বড় হলাম, মারামারির অভ্যাসটা আর গেল না। তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। মায়ের সাথে আজিমপুরের মেলায় গিয়েছিলাম। রাস্তার দুপাশে দোকান বসেছিল। মেলায় ঘুরে ঘুরে সংসারের জন্য অনেক তৈজস কিনেছিলেন মা। সেসবের মধ্যে ছিল বিভিন্নরকম খুন্তি। কোনোটার মুখ সূঁচাল, কোনোটা চ্যাপ্টা আবার কোনোটা ছিল গোল। আমি মায়ের সাথে আসতে আসতে খেয়াল করছিলাম, ছেলেরা ইচ্ছা করে মেযেদের গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছিল। মানে কোনো কিছু কেয়ার করছিল না। বিশেষ করে যারা কয়েকজনের এক এক দল হয়ে বের হয়েছিল ওই কাজটা তারাই বেশি করছিল। একজনকে খেয়াল করলাম, সে মানুষকে ইচ্ছা করে ধাক্কা দিতে দিতে মেলার ভেতরে ঢুকছে। মায়ের কাছ থেকে সূঁচাল খুন্তিটা নিলাম। ছেলেটাকে লক্ষ্য করে যেতে যেতে দেখলাম সে, রাস্তার একপাশে বসল। পেছন থেকে পরপর কয়েকটা খোঁচা মেরে দিলাম। পিঠের ওপর কয়েকটা বারি। এরপর আমি আর আশেপাশে নেই! একদৌড়ে মেলা থেকে বের হয়ে চলে এসেছি। মা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে অনেক বকা দিয়েছিলেন। ওতে সেদিন কষ্ট পাইনি, ছেলেটাকে যদি মেরে না আসতে পারতাম সেইটা হতো কষ্টের কারণ। মা খুব বোঝালেন, ‘মেয়ে হয়ে আর এই সব করতে যাবে না’। আমিও বললাম, ছেলে-মেয়ে বুঝিনা কেউ ঢিল ছুঁড়লে তাকে পাটকেল মারব। পা নিজের পছন্দে চুড়ি-ফিতা কিনে দিয়েছিলেন, আর আমার পছন্দে কেনা হয়েছিল ঘুড়ি। তখন বৈশাখ এলে যেন ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব হতো। কার বাড়ি থেকে ঘুড়ি উড়ছে বোঝার উপায় থাকত না। আকাশের দিকে তাকালে ঘুড়ি দেখা যেতো। কোনো কোনো ঘুড়ি ওড়ার শব্দ হতো খুব। ওই শব্দ এখনো মিস করি। আর ওই ছেলেটাকেও। ছেলেটি সেদিন অনেক ব্যথা পেয়েছিল, আমি নিশ্চিত। ওভাবে মারা ঠিক হয়নি। তবে মনে পড়লে এখনো বেশ ভালো লাগে…. অনুলিখন : স্বরলিপি রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ এপ্রিল ২০১৭/শান্ত