বিনোদন

সত্তা : বাংলা সিনেমার নতুনের শুরু

রুহুল আমিন : টালিগঞ্জের ‘মনের মানুষ’, ‘কালবেলা’ সিনেমা দেখার পর পাওলির প্রেমে পড়ি। এরপর পাওলি অভিনীত প্রায় সবগুলো সিনেমাই দেখার চেষ্টা করেছি। প্রিয় নায়িকা পাওলির সঙ্গে বাংলাদেশের শীর্ষ নায়ক শাকিব খান জুটি বেধে সিনেমা করছেন- এ সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই বেশ আগ্রহ তৈরি হয়। পরিচালক হিসেবে হাসিবুর রেজা কল্লোল ততটা পরিচিত না হলেও দেশের মিডিয়াতে তিনি বেশ পরিচিত। এপার বাংলার জনপ্রিয় নায়ক আর ওপার বাংলার প্রথম সারির নায়িকা নিয়ে সিনেমা হচ্ছে জেনে যে, আগ্রহ তৈরি হয়েছিল তা শেষ হয় গত এপ্রিলে।  যদিও এই সিনেমার ঘোষণা দেওয়া হয় ২০১৪ সালে। সত্তার টিজার দেখার পর আগ্রহ আরো বাড়ে। মুক্তি পাওয়ার পর তাই হলে গিয়ে সত্তা দেখি। সোহানী হোসেনের ‘মা’ শিরোনামের ছোট গল্প অবলম্বনে নির্মাণ করা হয়েছে সত্তা সিনেমাটি। আগেই বলে রাখি- মা গল্পটি আমার পড়া হয়ে উঠেনি। তবে সিনেমা দেখে মনে হয়েছে, হাসিবুর রেজা কল্লোলকে বেশ কসরত করেই ছোট গল্পটিকে চিত্রনাট্যে পরিণত করতে হয়েছে। সিনেমার শুরু হয় চুয়াডাঙ্গায় এক পারিবারিক আবহে। যেখানে গ্রামীণ পরিবেশে কনে শিখাকে (পাওলি) দেখতে  আসে বর পক্ষ। কনের বাবার পরিচয় নিয়ে শুরুতেই জটিলতা তৈরি হয়। এই জটিলতা থেকেই মূল গল্পে ঢুকেন পরিচালক। বর পক্ষের যৌতুক দিতে গিয়ে কনে মানে শিখার মা চোরাকারবারীর পথ বেছে নেয়। অবশেষে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। তখন আমরা জানতে পারি শিখার বাবা একজন ডোম। যিনি লাশকাটা ঘরে মদ খেয়ে পড়ে থাকেন। যে কারণে শিখার বিয়ের সময় পরিচয় দিতে চাননি শিখার মা। গুলিবিদ্ধ লাশ হাসপাতাল থেকে আনতে যায় শিখা। এ সময় তিনি ডাক্তারের লালসায় পরিণত হন। তারপর ডাক্তারকে খুন করে ট্রেনে করে সোজা ঢাকায়। অন্যদিকে বাবা-মাহীন মামা-মামির সংসারে বড় হওয়া সবুজ (শাকিব) মাদকাসক্ত। মামা মামি সবুজকে ধরিয়ে দেয় নেশার দ্রব্য। কমলাপুর স্টেশন, সোহরাওয়ার্দীসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আশপাশে বসে গাঁজা খায়। প্রয়োজনে মামা মামির কাছ থেকে টাকা আানে। একদিন স্টেশনেই দেখা হয় শিখার সঙ্গে সবুজের। আবার শিখা ভাগ্যের হেরফেরে ভিলেনের খপ্পরে পড়ে, সেখান থেকে পতিতালয়ে। তারপর সবুজের সঙ্গে প্রেম, মান অভিমান, বিয়ের আগে শিখার গর্ভে সন্তান, বিয়ের আয়োজন। এরপর ভিলেনদের কবলে পড়ে বিয়েতে সবুজের না আসা।তারপর শিখা গ্রামে খুন করেছে জেনে সবুজের অভিমান করে দূরে সরে যাওয়া, নেশাখোর থেকে ভিলেনদের লিডার হওয়া। মাদক ব্যবসায়ীকে মাদক খাওয়ানো। পুলিশ সবুজকে খোঁজা, শিখার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। চলতে থাকে মান-অভিমান। কাহিনির পরম্পরায় বৃষ্টিস্নাত রাস্তায় সন্তান প্রসব ও শিখার মৃত্যু। সিনেমা দেখা শুরু করার পর বিরতির কিছুটা আগ পর্যন্ত সাধামাটা কাহিনি মনে হয়েছে। আর পাঁচটা বাংলা সিনেমার কাহিনির মতোই মনে হয়েছে। তবে বিরতির পর সিনেমায় সাসপেন্স পাওয়া গেছে। শুরু থেকেই শিখার অভিনয় দুর্দান্ত ছিল। সবুজ  মানে শাকিব খানও তার অভিনয় জীবনের সেরা অভিনয়ের মধ্যে অন্যতম অভিনয়টা করেছেন সত্তায়। যদিও মাতালের অভিনয়টুকু অতি অভিনয় মনে হয়েছে। সিনেমায় মোট ছয়টি গান। সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন বাপ্পা মজুমদার। সত্তায় সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে বাপ্পার চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার অভিষেক হয়েছে। গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন মমতাজ, জেমস, বাপ্পা মজুমদার, সামিনা চৌধুরী, কণা, পান্থ কানাই, মিলা, পূজা ও সুমি শবনম। তবে জেমসের গাওয়া  ‘তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম’ ও মমতাজের গাওয়া  ‘না জানি কোন অপরাধে দিলা এমন জীবন’ গানটি ছাড়া বাকি চারটি গানের ব্যাপারে পরিচালক একটু ভাবতে পারতেন। তবে শুরুতে আবহ সংগীতের মতো করে বেজে ওঠা মমতাজের ‘না জানি কোন অপরাধে দিলা এমন জীবন’গানটি দারুণ লেগেছে। প্রথম হিসেবে ভালো করেছেন বাপ্পা মজুমদার। তবে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তথাকথিত বাংলা সিনেমার মতো একঘেয়ে লেগেছে। পুরো সিনেমায় বেশ কিছু গোজামিল চোখে পড়ে। চুয়াডাঙ্গার গ্রামীণ পরিবেশের একটা মেয়ে এতো চটপটে ঢাকায়া ভাষায় কথা বলে। কমলাপুর স্টেশন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সিনেমাতে মনে হয়েছে খুব কাছাকাছি একটা জায়গা। শিখা-সবুজ প্রেম খুব তাড়াতাড়ি দেখানো হয়েছে। এমনকি শিকার গর্ভে বাচ্চাও চলে আসে খুব তাড়াতাড়ি। মানে সিনেমেটিক অ্যাপ্রোচে আর্লি মনে হয়েছে। আর পতিতাদের ক্ষেত্রে বার বার রেট কত, সাইজ কত, ফিতা দিয়ে সাইজ মাপার দৃশ্য চোখে কেমন জানি লেগেছে। হাসপাতালে ভর্তির সময় শিখার নামের শেষে কি, মানে স্বামীর নাম কি জানতে চাওয়াটাও আমার কাছে কেমন বিশ্বাস যোগ্য মনে হয়নি। এখনো কি মেয়েদের নামের শেষে স্বামীর নাম লেখা বাধ্যতামূলক? নাকি শিখা গর্ভবর্তী ছিল, আর গর্ভবর্তী থাকলে হাসপাতালে নাম এন্টির সময় স্ত্রীর নামের শেষে স্বামীর নাম বলতে হয়? সবুজ গুলি করে প্রতিপক্ষের দুইজনকে হত্যা করে সাংবাদিকের কাছে তার ভিডিও রেকর্ড কি করে আসল? এক দৃশ্যে সবুজের ছোট চুল, পরের দৃশ্যেই বড় চুল। এই রকম ছোট খাটো বেশ কিছু অসামঞ্জস্য চোখে লেগেছে। দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রেও আরো নজর দেওয়া যেত। তারপরও গানের দৃশ্যে ইনানী বিচের দৃশ্য বেশ ভালো লেগেছে।  শিখা এই সিনেমার একমাত্র চরিত্র। আর পুরো সিনেমাটি এই চরিত্রের উপর দাঁড় করানো ছিল পরিচালকের দক্ষতার বিষয়। পরিচালক হাসিবুর রেজা কল্লোল সে কাজটি ৯০ ভাগ করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শিখার মন্দভাগ্যের সঙ্গে দর্শকদের ডুবিয়ে রাখা চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল। হাসিবুর রেজা কল্লোলের সফল এই ক্ষেত্রে। অন্তত আমি ডুবে ছিলাম। প্রথমদিকে সবুজ অতি অভিনয় করলেও বিরতির পর থেকে শিখার সঙ্গে দারুণ তালে অভিনয় করেছেন। তবে পার্শ্বচরিত্রগুলো বরাবরের বাংলা সিনেমার মতোই ম্যারম্যারে লেগেছে। কিছুটা হতাশাজনকও। এমনকি ভিলেনদের চরিত্রও হতাশাজনক ছিল। এই সব চরিত্রের ব্যাপারে পরিচালক আর একটু যত্ন নিতে পারতেন। সব মিলিয়ে বহুদিন পর বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি একটি ভিন্ন ধরনের কাহিনি ও চলচ্চিত্র পেল। মূল ধারায় নায়ক দিয়ে ভিন্ন ধারার গল্প বলার শুরুটা ভালো হয়েছে বলে মনে করি। রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ মে ২০১৭/রুহুল/শান্ত