বিনোদন

মানুষই যার প্রধান উপজীব্য

রুহুল আমিন : আর্নেস্ট ইঙ্গমার বার্গম্যান সুইডিশ চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, মঞ্চ পরিচালক, নির্দেশক ও নাট্যকার। বিশ্ব চলচ্চিত্রে বার্গম্যান খুব প্রভাবশালী পরিচালক। ১৯১৮ সালের ১৪ জুলাই সুইডেনের উপসালা শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।  আজ তার ৯৮তম জন্মবার্ষিকী। বার্গম্যানের সিনেমার প্রধান বিষয় ছিল মানুষ। মানুষের ভেতরের সুপ্ত মানুষটিকে তিনি বের করে আনতেন। মানুষের ভেতরের রাগ, মান-অভিমান, হিংসা, যৌনতা, দুঃখ কষ্ট সব কিছুকে তিনি বের করতেন অবলীলায়। প্রতিটা সিনেমা বানানোর আগে কাস্ট-মেম্বারদের তিনি একটা করে চিঠি দিতেন। কেন তিনি সিনেমাটা বানাচ্ছেন,  অভিনেতা-অভিনেত্রীর কাছে কী চাইছেন তিনি। রিহার্সালে খুব বিশ্বাস রাখতেন। অভিনেতা ও কলাকুশলীদের সঙ্গে কথা বলে কাজ করতেন। আর মানুষ যে তার সিনেমার প্রধান বিষয় ছিল বার্গম্যান সে কথা প্রায়ই বলতেন- আমার সিনেমাতে মানুষই প্রধান। একটা দৃশ্যকে আমি কী করে নির্মাণ করব, সেটা তো ভেবেচিন্তে করে ফেলাই যায়। কিন্তু আসল শুরু মানুষেই, আর মানুষই শেষ কথা। বার্গম্যান বলতেন, সিনেমা হচ্ছে একটা স্বপ্নের মতো। বাহ্য কোনো প্রকাশ নেই। ছুঁয়ে চলে যায় আর বদলে দিয়ে যায়। স্বপ্নে যেমন কোনো যুক্তিক্রম থাকে না বরং অতিবাস্তবতা থাকে, সিনেমাও তাই। মুহূর্ত দিয়ে দিয়ে তৈরি হয়। বার্গম্যানের বাবা ছিলেন চার্চের পুরোহিত। কঠোর পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুশাসনে বড় হওয়া বার্গম্যান পরবর্তীকালে নিজের কাজেই খুঁজেছিলেন ঈশ্বর ও মানুষের সম্পর্ক। স্টকহোমে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যুক্ত হন মঞ্চের সঙ্গে।  তখনই বড় পর্দায় অভিষেক ‘টরমেন্ট’ সিনেমার মাধ্যমে। ১৯৪৪ সালে বার্গম্যানের চিত্রনাট্যে সিনেমাটি বানিয়েছিলেন আলফ হোবারিয়া। ১৯৫৫ সালে ‘স্মাইলস অব অ্যা সামার নাইট’ সিনেমার মাধ্যমে নির্মাতা হিসেবে প্রথম আন্তর্জাতিক সাফল্য পান তিনি। এরপরই তিনি বানান ‘দ্য সেভেন্থ সিল’, ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’, ‘দ্য ভার্জিন স্প্রিং’- এর মতো সাড়া জাগানো সব সিনেমা। ওই বছর বিদেশি ভাষার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে ‘দ্য ভার্জিন স্প্রিং’অস্কার পেয়েছিল। পরে তিনি দুটি ট্রিলজি বানান। প্রথমটি হলো- ‘থ্রু অ্যা গ্লাস ডার্কলি’, ‘উইন্টার লাইট’ ও ‘দ্য সাইলেন্স’। ‘থ্রু অ্যা গ্লাস ডার্কলি’ সিনেমাটিও  বিদেশি ভাষার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার পেয়েছিল।  দ্বিতীয় ট্রিলজিটি ছিল ‘পারসোনা’, ‘আওয়ার অব দ্য উলফ’ ও ‘শেম’।  এরপর নির্মাণ করেন ‘সিনস ফ্রম অ্যা ম্যারেজ’। বার্গম্যানের জীবনে বড় ধরনের ধাক্কা আসে আশির দশকে। ১৯৭৬ সালে আয়কর ফাঁকির অভিযোগে বার্গম্যানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন তিনি মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েন। পরে অবশ্য তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু বার্গম্যানকে খুব আঘাত করে বিষয়টি। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, সুইডেনে আর সিনেমা বানাবেন না। এ সময় সুইডেনের দ্বীপ ফারোতে তার যে স্টুডিও ছিল, সেটিও বন্ধ করে দেন তিনি। এ সময় সুইডেন ছেড়ে জার্মানিতে পাড়ি জমান বার্গম্যান। পরবর্তীতে তিনি যৌথ প্রযোজনার কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। সেগুলো হলো- ‘দ্য সারপেন্ট’স এগ’, ‘দ্য টাচ’, ‘অটাম সোনাটা’, ‘ফ্রম দ্য লাইফ অব দ্য ম্যারিওনেটস’। ১৯৮২ সালে স্বল্প সময়ের জন্য তিনি সুইডেন আসেন। সেবার সুইডেনে নির্মিত ‘ফ্যানি অ্যান্ড আলেক্সান্ডার’ সিনেমাটি চারটি বিভাগে অস্কার জিতেছিল। ২০০৩ সালে তিনি তার শেষ সিনেমা ‘সারাব্যান্ড’ নির্মাণ করেন। এটি ‘সিনস ফ্রম আ ম্যারেজ’ সিনেমার সিক্যুয়েল। একই বছর তিনি সিনেমা পরিচালনা থেকে অবসর নেন। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে তার নিতম্বে অস্ত্রোপচার করা হয়। এরপর অনেক কষ্টভোগের পর আরোগ্য লাভ করেন তিনি। কিন্তু ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই সুইডেনের ফারো আইল্যান্ডের গটল্যান্ডস লেনের নিজ বাড়িতে ঘুমের মধ্যে তিনি মারা যান। বিখ্যাত জাপানি পরিচালক কুরোসাওয়া বলতেন, সিনেমাতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হল ‘সিমপ্লিসিটি’  ‘অ্যাচিভ’ করা। বার্গম্যানকে তা ‘অ্যাচিভ’ করতে হতো না। সিমপ্লিসিটি ওর সিনেমাতেই  নিহিত ছিল। বার্গম্যান প্রায় ৫০টি চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো আত্মজৈবনিক। মৃত্যু ও বিশ্বাসঘাতকতা তার সিনেমায় ঘুরেফিরে বারবার এসেছে। অনেক নির্মাতা তার কাজ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। মার্কিন পরিচালক উডি অ্যালেন তাদের একজন। উডি অ্যালেনের মতে, এ যাবৎ যত চলচ্চিত্রকার জন্ম নিয়েছেন তাদের সবার সেরা বার্গম্যান। বার্গম্যানকে নিয়ে বাঙালি কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটক সম্পর্কিত একটা গল্প চালু আছে। ভারতের পুনের 'ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া বা ‘এফটিআইআই’-এ তখন ঋত্বিক ঘটক পড়াতেন। বার্গম্যানের সঙ্গে ঋত্বিক ঘটকের কোথাও একটা দার্শনিক সংঘাত ছিল। বার্গম্যানের বিষয়ে কখনোই তিনি উচ্চবাচ্য করতেন না। একবার বার্গম্যানের একটি সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছিল, তো এক ছাত্র ছবি না দেখে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।  ঋত্বিক তাকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, কেন, আপনিই তো বলেন ওর সিনেমা আপনার ভালো লাগে না। তখন নাকি ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, ‘দ্যাট’স বিটুইন টু মাস্টার্স। যাও, সিনেমা দেখো, শেখো ওর কাছ থেকে!’

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জুলাই ২০১৭/রুহুল/শান্ত