বিনোদন

মহানায়কের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

রুহুল আমিন : বাংলা চলচ্চিত্রে ‘মহানায়ক’খ্যাত কিংবদন্তি অভিনেতা উত্তম কুমার। প্রকৃত নাম অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। ভারতীয়-বাঙালি এই চলচ্চিত্র অভিনেতা চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনাতেও যুক্ত ছিলেন। চলচ্চিত্রে অভিনয় ছাড়াও সফলভাবে মঞ্চেও অভিনয় করেন তিনি। ১৯৮০ সালের এই দিনে (২৪ জুলাই) তিনি মারা যান। আজ মহানায়কের ৩৭তম প্রয়াণ দিবস। এই দিনে তার প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার ৫১ নং আজিরীটোলা স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন উত্তম কুমার। তার বাবার নাম সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম চপলা দেবী। তার ছোট ভাই তরুণ কুমার একজন শক্তিশালী অভিনেতা ছিলেন। তারা একত্রে বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন (যেমন: মায়ামৃগ, ধন্যি মেয়ে, সপ্তপদী (চলচ্চিত্র), সোনার হরিণ, জীবন-মৃত্যু, মন নিয়ে, শেষ অঙ্ক, দেয়া-নেয়া, সন্ন্যাসী রাজা, অগ্নীশ্বর ইত্যাদি)। উত্তম কুমার কলকাতার সাউথ সাবার্বা‌ন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং পরে গোয়েঙ্কা কলেজে ভর্তি হন। কলকাতার পোর্টে চাকরি নিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারেননি তিনি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। নীতিন বোস পরিচালিত ‘দৃষ্টিদান’ সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় উত্তম কুমারের। এর আগে অবশ্য ‘মায়াডোর’ নামে একটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছিলেন তিনি। কিন্তু সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। ‘বসু পরিবার’ চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ মুক্তি পাওয়ার পর তিনি চলচ্চিত্র জগতে স্থায়ী আসন লাভ করেন। সাড়ে চুয়াত্তর সিনেমায় তিনি প্রথম অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয় করেন। এই সিনেমার মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সফল উত্তম-সুচিত্রা জুটির সূত্রপাত হয়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে উত্তম-সুচিত্রা জুটি অভিনীত অনেকগুলো চলচ্চিত্র ব্যবসায়িকভাবে সফল এবং একইসঙ্গে প্রশংসিত চলচ্চিত্রের মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো- হারানো সুর, পথে হল দেরী, সপ্তপদী, চাওয়া পাওয়া, বিপাশা, জীবন তৃষ্ণা ও সাগরিকা। বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন উত্তম। তার অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রের মধ্যে ছোটি সি মুলাকাত, অমানুষ এবং আনন্দ আশ্রম অন্যতম। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। প্রথমটি নায়ক এবং দ্বিতীয়টি চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানা চলচ্চিত্রে তিনি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। রোমান্টিক সিনেমার ফাঁকে দু’একটা ভিন্ন ঘরানার সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন তিনি। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত উত্তম-সুচিত্রা জুটি ৩০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এ চলচ্চিত্রগুলোর বেশির ভাগই ছিল ব্যবসাসফল। এই জুটি আজও দর্শক হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে। বাংলা চলচ্চিত্রের দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও এ জুটির জনপ্রিয়তা এতটুকুও স্পর্শ করতে পারেনি অন্য কোনো জুটি। সুচিত্রা সেন ছাড়াও সেই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুপ্রিয়া চৌধুরী, সাবিত্রী চ্যাটার্জি, মাধবী মুখার্জি, শর্মিলী ঠাকুর, অঞ্জনা ভৌমিক, অপর্ণা সেন ও সুমিত্রা মুখার্জির সঙ্গেও জুটি বেঁধে ব্যাপক সফলতা পান উত্তম। উত্তম কুমার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে প্রায় ২০৯টি সিনেমায় অভিনয় করেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই দর্শকপ্রিয় ও ব্যবসাসফল। তার উল্লেখযোগ্য বাংলা চলচ্চিত্র হলো- দৃষ্টিদান, সাড়ে চুয়াত্তর, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, মায়ামৃগ, থানা থেকে আসছি, কুহক, সাগরিকা, শিল্পী, হারানো সুর, ইন্দ্রানী, সবার উপরে, এন্থনি ফিরেঙ্গি, অপরিচিতা, নায়ক, চিড়িয়াখানা, ধন্যি মেয়ে, জীবন-মৃত্যু প্রভৃতি। এসব সিনেমার মাধ্যমে নিজেকে বাংলা চলচ্চিত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক হিসেবে প্রমাণ করেন উত্তম কুমার। যার ফলে ভক্ত-দর্শক তাকে মহানায়ক উপাধিতে ভূষিত করেন। অসাধারণ অভিনয়ের জন্য একাধিকবার সেরা নায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। এ ছাড়াও পেয়েছেন দেশ বিদেশের অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। উত্তমের সেই ভুবন ভোলানো হাসি, প্রেমিকসুলভ আচার-আচরণ বা ব্যবহারের বাইরেও যে থাকতে পারে অভিনয় এবং অভিনয়ের নানা ধরন, মূলত সেটাই তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। রোমান্টিক নায়ক ছাড়াও অন্যান্য চরিত্রেও তিনি ছিলেন অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। মঞ্চের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালোবাসা। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৫৫ সালে যখন তিনি বাংলা সিনেমার সুপার হিরো। শত ব্যস্ততার মাঝেও মঞ্চের ডাকে সাড়া দিয়ে ‘শ্যামলী’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। সংগীতের প্রতিও ছিল তার আগ্রহ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে ও শ্যামল মিত্রের গানেই সবচেয়ে বেশি ঠোঁট মিলিয়েছেন উত্তম। সিনেমার গান রেকর্ডিংয়ের সময় শিল্পীর পাশে বসে তার অনুভূতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন তিনি। এর ফলে গানের সঙ্গে পর্দায় ঠোঁট মেলানো তার পক্ষে খুবই সহজ হতো। সংগীতপ্রেমী উত্তম ‘কাল তুমি আলেয়া’সিনেমার সবগুলো গানের সুরারোপ করেন। সিনেমাটি ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায়। উত্তম কুমার গৌরী দেবীকে বিয়ে করেছিলেন। তাদের একমাত্র সন্তান গৌতম চট্টোপাধ্যায় ৫৩ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। উত্তম কুমারের একমাত্র নাতি গৌরব চট্টোপাধ্যায় বর্তমানে টালিগঞ্জের অভিনেতা। ১৯৬৩ সালে উত্তম কুমার তার পরিবার ছেড়ে চলে যান। দীর্ঘ ১৭ বছর তিনি তৎকালীন জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে বসবাস করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।

       

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জুলাই ২০১৭/রুহুল/শান্ত