মো. আব্দুল জব্বার একটি নাম। এটাই বাংলাদেশের বড় প্রাপ্তি এবং অহংকার। ইথারে বহুল প্রচারিত তাঁর কণ্ঠ। তিনি জাতীয় কণ্ঠশিল্পী, দেশপ্রেমিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বন্ধুবৎসল, প্রাণবন্ত একজন পরোপকারী মানুষ। বাংলাদেশে এমন একজনকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি এই নামটির সাথে পরিচিত নন; এই কণ্ঠ যার অপরিচিত। জন্ম-১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর, কুষ্টিয়ায়। ছোটবেলা থেকেই সংগীত অনুরাগী। শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভারতীয় বিভিন্ন শিল্পীদের গান গেয়ে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন সেই ছোটবেলা থেকেই। ১৯৫৮ সাল থেকে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে নিয়মিত সংগীত পরিবেশন শুরু করেন। ১৯৬২ সালে প্রথম ছায়াছবিতে কণ্ঠ দেন। ১৯৬৪ সাল থেকে নিয়মিত তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশন কর্পোরেশনে তাঁর সংগীত পরিবেশনা শুরু। সে-সময় থেকেই তাঁর দরাজ এবং আবেগী কণ্ঠ খুব সহজেই মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই শিল্পীকে মাঝে মাঝেই তাঁর বাসায় ডেকে নিতেন গান শোনার জন্য। সেই সুবাদে জব্বার ভাই বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। তেমনি তিনিও হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধুর প্রিয় শিল্পী। জব্বার ভাইয়ের মুখে শুনেছি, তিনি বঙ্গবন্ধুকে ‘বাবা’ সম্বোধন করতেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর থেকে আজ অবধি জব্বার ভাই বঙ্গবন্ধুকে ‘বাবা’ বলেই সম্বোধন করে আসছেন। জব্বার ভাইয়ের মুখেই শুনেছি যে, বঙ্গবন্ধু তাঁকে ‘পাগলা’ বলে ডাকতেন। এখানেই জব্বার ভাইয়ের একটি অন্যরকম পরিচিতি পাওয়া যায়। সত্যি বলতে, তিনি একজন জাত শিল্পী বলেই তাঁর ভেতরে শৈল্পিক কিছু পাগলামী আছে। আর তাই হয়তো মজা করেই বঙ্গবন্ধু তাঁকে ‘পাগলা’ বলে ডাকতে পছন্দ করতেন। মো. আব্দুল জব্বার এ পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত দেশের সর্বোচ্চ তিনটি পুরষ্কারে তিনি ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক, ১৯৮০ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পদক। তাঁর যেসব গান অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল- ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়,’ ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ (সমবেত), ‘তারাভরা রাতে তোমার কথা মনে পড়ে বেদনায়,’ ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ এবং ‘ওরে নীল দরিয়া আমায় দে রে দে ছাড়িয়া,’ ‘নিঠুর পৃথিবী দিয়েছ আমায় আঁখিজল উপহার,’ ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি’, ‘শত্রু তুমি বন্ধু তুমি, তুমি আমার সাধনা’ প্রভৃতি। দেশের এই গুণী শিল্পী ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি সেই সময় আগরতলা থেকে এবং পরে কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে কালজয়ী ঐতিহাসিক গান করেন। তিনি সেখানে গলায় হারমনিয়াম ঝুলিয়ে কলকাতার বাংলাদেশী শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পগুলোতে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। এ ছাড়াও তৎকালীন বোম্বে, জয়পুরসহ বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করে ভারতীয় বারো লাখ রুপি সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ তহবিলের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদের হাতে তুলে দেন। আমাদের গর্ব, এই শিল্পী গত প্রায় দুই মাস যাবৎ অসুস্থ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬২০নং ভিআইপি কেবিনে ভর্তি রয়েছেন। কিন্তু গত ১ আগস্ট থেকে তাঁকে আইসিউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। জব্বার ভাইয়ের দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁর পায়ুপথ দিয়ে রক্ত ঝরছে! তাঁর পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী শিল্পীকে অতি দ্রুত দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য না পাঠালে তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব হবে না। তাঁরা এমন পরিস্থিতিতে অসহায় হয়ে পড়েছেন এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। খুবই দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, একজন মো. আব্দুল জব্বার অর্থের অভাবে নিজের চিকিৎসা করাতে পারছেন না! তিনি বলেছেন, ‘আমি মারা গেলে শহীদ মিনারে নিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন, এটা আমি চাই না। আমি বাঁচতে চাই!’ আমি গত ৩১ জুলাই রাতে হাসপাতালে জব্বার ভাইকে দেখতে গেলে তিনি আমার হাত ধরে অনেক কষ্টে বলেন, ‘তিমির, বাংলাদেশের মানুষ যদি আমাকে এক টাকা করেও দেন, তবে তো ১৬ কোটি টাকা সংগৃহীত হবে, কিন্তু আমার তো অত টাকার প্রয়োজনও নেই!’ আর এ কারণে আমরা ‘কণ্ঠশিল্পী মো. আব্দুল জব্বার চিকিৎসা সহায়তা কমিটি’ গঠন করেছি, যেখানে উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম এবং চিত্রনায়ক ফারুক। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন সাংবাদিক ও গীতিকবি আলী আশরাফ আখন্দ এবং আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছি আমি। আমরা এই কমিটি থেকে গত ৬ আগস্ট সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল শিল্পী, ব্যাংক-বীমা, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং বিত্তশালীদের জব্বার ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছি। এ ছাড়াও আমরা এই কমিটি থেকে বর্তমান সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি। যে মানুষটি বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছেন, যে মানুষটি সেই আমলে মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে ১২ লাখ রুপি সংগ্রহ করে দিয়েছেন, অর্থের অভাবে তাঁরই এখন চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম! এর চেয়ে দুঃখের এবং লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে? আমরা জানি, দেখেছি যে, বর্তমান সরকার খুবই শিল্পীবান্ধব; জব্বার ভাইকে সাহায্যও করেছেন। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরী এবং তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, তাঁর সরকার শিল্পীদের প্রতি সুনজর দেবে, যাতে কোনো শিল্পী কষ্ট না পান বা কষ্টে না থাকেন। আশাকরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশবরেণ্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা, কণ্ঠশিল্পী মো. আব্দুল জব্বারকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য সম্ভাব্য তড়িৎ ব্যবস্থা নেবেন। জব্বার ভাইয়ের চিকিৎসায় এখন যদি এক, দুই কোটি টাকার প্রয়োজন পড়েই যায়, তবে তা কি খুব বেশি? দেশের জন্য তাঁর যে অবদান, তা কি এই অর্থের মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করা যায়? নিশ্চয়ই নয়। পরিশেষে জব্বার ভাইয়ের আশু অরোগ্য কামনা করি। তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। তাঁর গাওয়া বিখ্যাত গানের কলি দিয়ে শেষ করতে চাই: ‘কেউ তো জানে না প্রাণের আকুতি বারে বারে সে কি চায় স্বার্থের টানে প্রিয়জন কেন দূরে সরে চলে যায় আকাশে-বাতাসে নিষ্ফল আশা হাহাকার হয়ে রয়।’ আমি বলতে চাই, এই কিংবদন্তি শিল্পীর বাঁচার আকুতি যেন হাহাকার এবং নিষ্ফল না হয়। এখন তাঁর পাশে আমাদের সবার দাঁড়ানো উচিৎ। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা রাখা উচিৎ। আর তা না হলে আমরা জাতি হিসেবে অকৃতজ্ঞ হয়েই রইবো!
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ আগস্ট ২০১৭/তারা