বিনোদন

তারেক মাসুদের সেই ‘রাজা’ আমি

ফজলুল হক রুহুল: ‘রানওয়ে’ সিনেমার কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালের অক্টোবরে। অডিশনের মাধ্যমে আমি এই চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। চলচ্চিত্রের মূল কাজ যেদিন শুরু হলো- প্রথম শট দিতে গিয়ে ভয় পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, ফ্রেমে আছি তো! এয়ারপোর্টের একেবারে কাছের একটি বাড়িতে। প্রথম দৃশ্যটি ছিল এরকম যে, আমাকে একটি গরু ধরতে হবে। মা বলছিলেন, রুহুল গরুটা ধর তো...। আমি ধরতে যাচ্ছিলাম কিন্তু ঠিক মতো ধরতে পারছিলাম না। কোনো রকমে প্রথম দিনের শুটিং শেষ হলো। এরপর তারেক মাসুদ ভাই রুমে আমাকে ডেকে নিলেন। বললেন, রানওয়ে একটি চলচ্চিত্র। আর এই চলচ্চিত্রে তুমি ‘রাজা’। রাজা যেভাবে শাসন করবে রাজ্য সেভাবে চলবে। রাজার ভুল হবে কিন্তু তা নিয়ে ভয় পেলে চলবে না। রাজার মনে রাখতে হবে বাকী জনগণ তার। এভাবে তাদের শাসন করতে হবে। বুঝলে...! কথাগুলো ম্যাজিকের মতো কাজ করল। কী এক শক্তি যেন মনের ভেতর পৌঁছে গেল। পুরো চলচ্চিত্রে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে আমি আর নার্ভাস ফিল করিনি। এই চলচ্চিত্রে একাধিকবার বিমান আসা-যাওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। এবং এই দৃশ্য ছিল বাস্তব। বিমান কখন কোনটা আসবে সেই শিডিউল তারেক মাসুদ জানতেন। সেই অনুযায়ী টিমের সবাই প্রস্তুত থাকত। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে বিমান আসছে-যাচ্ছে আর ঘরটা কাঁপছে। মূলত ঘরটা কাঁপানো হতো। অনেকে মিলে এই কাজটা করত। শুরু থেকে শেষ একটা ঘোরের ভেতর দিয়ে গিয়েছি। সিনেমার একটা পর্যায়ে পাথর মাঝে রেখে রোমান্টিক আলাপের দৃশ্য আছে। এই দৃশ্যে যখন অভিনয় করেছিলাম সেটে উপস্থিত সবাই খুব মজা করেছিলেন। কিন্তু তারেক মাসুদ ভাই তেমন কিছু বলেননি। সেটে খুব হাসতেন না আবার কোনো শিল্পীর সঙ্গে জোরে কথাও বলতেন না। কিন্তু আমি খেয়াল করে দেখেছি যে, সবাই তাকে ভয় পেতেন। এটা হয়তো সম্মান থেকে হতো। একটা ঘটনা বলি, চরিত্রের প্রয়োজনে আমার দাড়ি-গোঁফ একটু বড় রাখতে হয়েছিল। একবার কিছু দিনের জন্য শুটিং বন্ধ রাখা হয়েছিল। আমি ঠিক জানতাম না- আবার কবে কোথায় শুটিং শুরু হবে। আমার দাড়ি-গোঁফ একটু বেশিই বড় হয়ে যাচ্ছিল। নিজে নিজে ছেটে নিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর মনে মনে খুব ভয় পেয় যাই। তারপর তারেক মাসুদ ভাইয়ের অফিসে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানালাম। যাকে জানালাম মনে হলো তিনি নিজেই আমার চেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছেন। আমাকে ডেকে পাঠালেন। অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম তার ঠিক দুই দিন পরই আবার শুটিংয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে। অফিসে যারা ছিল তারা বললেন, তারেক মাসুদ ভাইয়ের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে হবে। গাড়ি দিয়ে আমাকে স্যারের বাসায় তারা পাঠিয়ে দিলেন। বাসার দরজা খুললেন তারেক ভাই নিজেই। আমি বাসায় যাওয়ার আগেই তিনি সব জেনে গিয়েছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, না ঠিক আছে।

 

উহ্। জীবন পেলাম যেন! মুন্সীগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, উত্তরার বিভিন্ন জায়গায় শুটিং হলো। আরো অন্যান্য কাজ শেষে তারেক ভাই পরিচিত কয়েকজনকে তার বাসায় ডেকে নিলেন। বলতে গেলে প্রথম প্রদর্শনী হলো। চলচ্চিত্রটি দেখা শেষ হলে, কাছে বসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে কী মনে হয়- তোমার যে জেনারেশন বা এর পরের যে জেনারেশন তারা একটি ম্যাসেজ পাবে? আমি এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে একটি ম্যাসেজ দিতে চেয়েছি তুমি কি বুঝতে পেরেছ?

 

আমি বললাম, হ্যাঁ পেরেছি। আমার কথা শুনে তিনি সেদিক মুচকি হেসেছিলেন।

শুরুতেই বললাম, 'রাজা'একটি ধারণা তিনি আমার মাথায় দিয়ে দিয়েছিলেন। সরাসরি সেই রাজাকে দেখতে পাওয়ার সুযোগ এলো একদিন। গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হলো। এর আগেও ঢাকার বাইরে রানওয়ের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হয়েছিল কিন্তু আমি যাইনি। গাজীপুরে যাওয়ার জন্য বললেন তারেক ভাই। আমি গেলাম। গিয়ে দেখি, শো চলছে। শেষের দিকে। তারেক ভাইয়ের সাথে আমার ফোনে কথা হলো। বললেন, এখন তো আমার এখানে আসা কঠিন হয়ে যাবে। তুমি পেছনেই দাঁড়াও। কত মানুষ! সিনেমা দেখছে। স্ক্রিনে আমার মুখ। এই সমাগত মানুষের পেছনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। কেউ চিনতে পারছে না। সিনেমা শেষ হলো। তার একটু পরই আর একটি শো। মঞ্চে উঠে গেলেন তারেক ভাই। কথা বলছিলেন। একসময় বললেন, 'আপনারা এতক্ষণ যার অভিনয় দেখলেন সে এখানেই উপস্থিত আছে।’ ডাক দিলেন 'রুহুল মঞ্চে চলে এসো।’ একেবারে পেছনের সারি থেকে সামনের দিকে যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম সামনে থেকে সবাই পেছনের দিকে তাকাল। সে এক বিস্ময়কর অনুভূতি! কেউ শিস দিচ্ছে। কেউ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য। সত্যিই আমি কিছু সময়ের জন্য ‘রাজা’ হয়ে গেলাম। একজন তরুণ অভিনেতা একটা সঞ্চয় পেয়ে গেল। তারেক ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে অনেককে অটোগ্রাফও দিয়েছিলাম সেদিন। আমার সেটি অটোগ্রাফ দেওয়ার প্রথম দিন। ভেবেছিলাম তারেক মাসুদ ভাইযের সঙ্গে একাধিক কাজের সুযোগ পাবো। তারেক ভাই যখন 'কাগজের ফুল' চলচ্চিত্র বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে রেখেছিলেন দলে। এরপর... ঘটনা তো আমাদের সবারই জানা। প্রথম যখন জানলাম তিনি নেই আমি মানতে পারিনি। টিভি স্ক্রল দেখে সংবাদটি জানলাম। একাধিক স্টেশনের খবর দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল, খবরটা ভুল প্রমাণিত হোক। নিহত না হয়ে খবরটা আহতেরও হতে পারত কিন্তু সবগুলো স্টেশনের খবর ছিল এক! এখনো মাঝে মাঝে মনে পড়ে। একটি দৃশ্যের পর তারেক ভাই জানতে চেয়েছিলেন 'আঘাত লেগেছে তোমার?’ বলেছিলাম, 'না।’ রানওয়ের একটা দৃশ্যে দেখা যায় একটি প্রাইভেট কারের সঙ্গে রিকশা লেগে যায়। প্রাইভেট কার থেকে একজন নেমে আমাকে আঘাত করে। আশপাশে লোক জমে যায়। ওখানে টিমের বাইরের যারা জমায়েত হয়েছিলেন তারা কিন্তু বুঝতেও পারেননি ওখানে শুটিং হচ্ছে। কারণ ক্যামেরা লুকানো ছিল। তারেক ভাই মনে করেছিলেন আমি ব্যথা পেয়েছি। আঘাত সেদিন পাইনি। পেয়েছি যেদিন তারেক ভাই সবকিছু ছেড়ে গেলেন সেইদিন। অথচ ‘আঘাত লেগেছে তোমার?’ এই প্রশ্নটি আর কেউ করে না। অনুলিখন : স্বরলিপি রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ আগস্ট ২০১৭/শান্ত/তারা