বিনোদন

আমাকে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা দিতে হয়েছে: চয়নিকা

গুণী নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী। তার নির্মিত নাটক-টেলিফিল্মের সংখ্যা তিনশ ষাটটি। নারী নির্মাতা হিসেবে তার পথচলা সহজ ছিল না। দীর্ঘ ১৭ বছরের ক্যারিয়ার নানা উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে কেটেছে। নারী দিবসে আমরা জানতে চেয়েছিলাম তার পথচলার সেই গল্প। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমিনুল ইসলাম শান্ত। রাইজিংবিডি: চিত্রনাট্যকার থেকে নির্মাতা। অনুপ্রেরণায় কে ছিলেন?

চয়নিকা: একবার লেখক সম্মানী আনতে গিয়েছিলাম ‘লাইট অ্যান্ড শ্যাডো’ নামের একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানে। তখন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম-নাটকটির পরিচালক কে? তখন তিনি বলেছিলেন, নাট্যকার, পরিচালক দুটোই আপনি। আমিও তখন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, ঠিক আছে আমি পারব। আসলে আমি কারো অনুপ্রেরণায় নির্মাণ কাজে আসিনি। আমিই আমার প্রেরণা। তবে একজন মানুষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তিনি জায়েদান রাব্বি। তার কারণেই বিটিভিতে আমার নাটকগুলো প্রচারিত হতো।    রাইজিংবিডি: নারী পরিচালক হিসেবে শুরুতে কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন কি?

চয়নিকা: পরিচালকদের জেন্ডার নেই। যেহেতু আমি নারী, তাই নারীর প্রসঙ্গ আসে। আর শুরুতে আমি ঠিক ওভাবে কোনা বাধা পাইনি। আমার মায়ের হাত ধরে তিন বছর বয়স থেকে মিডিয়াতে কাজ করি। নাচ, গান, অভিনয় আমি জানি। এগুলো আমার মায়ের অনুপ্রেরণায় শিখেছি। ফলে আমি জেনেশুনেই এসেছি। আমি খুবই সৌভাগ্যবতী। আমার বিষয়ে অনেকে বলেন, ‘আপনার নাটক টেলিভিশনে বেশি প্রচারিত হয় কারণ আপনি নারী।’ কথাগুলো শুনতে ভালো লাগে না। এই বিষয়টিকে আমি বাধা মনে করি। যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই আমি আজকের অবস্থানে এসেছি। তদবির করে নাটক নির্মাণ করিনি। নির্মাণ করে চ্যানেলে জমা দিয়েছি, চ্যানেল প্রিভিউ করেছে তারপর ওকে হয়েছে এবং প্রচারিত হয়েছে। এভাবে আমাকে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা দিতে হয়েছে। পরীক্ষা দিতে দিতে আমি আজকের চয়নিকা। আমি কাজ জানি, ভালো কাজ করতে পারি- এই বিশ্বাস এবং যোগ্যতা আমাকেই অর্জন করতে হয়েছে। এখন শুধু আমাকে দিয়ে তো বাংলাদেশকে বিবেচনা করা যাবে না। আমি যখন নির্মাণ কাজ শুরু করি, তখন দুজন মেয়েকে সহকারী হিসেবে চেয়েছিলাম। ওরা যখন আমার সঙ্গে কাজ করতে আসে তখন দেখলাম, ওরা পরিবারের সহযোগিতা পাচ্ছে না। একবার এক মেয়ে, সারারাত বাসার বাইরে বসে ছিল। কারণ রাত ১০টায় তার বাসার গেট বন্ধ হয়ে যায়। আবার অনেক মেয়ের স্বামী বলেছে, ‘এত রাত পর্যন্ত কী করলা? এত দেরি হলো কেন?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। সর্বশেষ ওরা কিন্তু কাজ করতে পারেনি। কারণ ওরা পরিবারের সহযোগিতা পায়নি। প্রথমে একটি মেয়ের পরিবারের সহযোগিতা অনেক বেশি দরকার। যেটা আমি পেয়েছি। কিন্তু ওই মেয়ে দুটো পায়নি, এটা বাস্তবতা। রাইজিংবিডি: নির্মাণ কাজের শুরুতে আপনি যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তা কি এখনো আছে?

চয়নিকা: না, কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমরা মুখে মুখে অনেক বড় কথা বলি। একটি পরিবারে গৃহিণী সবচেয়ে কঠিন ও সম্মানের কাজটি করছেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওই মানুষটি কাজ করে যাচ্ছেন অথচ সে কিন্তু ওই কাজের বিনিময়ে কোনো বেতন পাচ্ছেন না। এমনকি পিতৃতান্ত্রিক একটি পরিবারের সেই গৃহিণী সম্মানটুকুও পাচ্ছেন না। এটা ৮০ ভাগ পরিবার দিচ্ছে না। আসলে ঘর থেকে একজন নারীকে যখন সম্মান জানানো হবে তখন নারী সামনে এগিয়ে যাবে এবং তার পথচলা অনেক মসৃণ হবে। আর নারীরা এখন নির্মাণে আসতে পারছে না, কারণ পরিবার থেকে তারা কোনো সাপোর্ট পাচ্ছে না। তাছাড়া এটি অনেক ধৈর্যের বিষয়। শুটিং শুরু হওয়ার আগে, শুটিংয়ের সময় এবং শুটিংয়ের পর অনেক কাজ থাকে। কাজ করতে করতে অনেক দিনই রাত হয়ে যায়। সব পরিবার এখনো এগুলো নিতে পারে না। যতদিন গৃহিণী সম্মান পাবে না, ততদিন এরকম চলতে থাকবে। এই সম্মানের শিক্ষাটা পরিবার থেকে আসে। আমি পরিবার থেকে সম্মান পাই এবং দেই। কিন্তু সব মেয়ে আমার মতো পায় না। তারপরও অনেক বাধা পেরিয়ে এ পর্যন্ত এসেছি। রাইজিংবিডি: শোবিজ অঙ্গনের নারীদেরকে সমাজ এখনও অন্যচোখে দেখে, বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?

চয়নিকা: আমার কাছে বিষয়টি হাস্যকর মনে হয়। খারাপ-ভালো সব জায়গাতেই আছে। আপনি কর্পোরেট জগতে দেখেন, ওখানে আরো বেশি খারাপ। শোবিজের কোনো দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদ হলে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু যাদের মানুষ চেনে না তাদেরও তো বিচ্ছেদ হচ্ছে। এমন ঘটনা আমাদের সমাজে অনেক ঘটছে- তাদের নিয়ে তো খারাপ আলোচনা হয় না? কারণ মানুষ তাদের চেনে না। এগুলো আমার কাছে খুবই মূল্যহীন বিষয় বলে মনে হয়। রাইজিংবিডি: কিছুদিন আগে এক অভিনেত্রী প্রযোজকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন…

চয়নিকা: ও কেন অভিযোগ তুলেছিল আমি জানি না। আমি মিডিয়াতে ১৭ বছর ধরে কাজ করছি। আমরা খুব সুন্দরভাবে কাজ করছি। আমাকে কোনো প্রযোজক বা অন্য কেউ এ ধরনের কথা কখনো বলেনি কিংবা বলার সাহস করেনি। এমনকি আমার সেটেও এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটা ওই অভিনেত্রী ভালো বলতে পারবেন। আর একজন বলেছে বলেই কিন্তু পুরো মিডিয়া খারাপ না।  নির্মাণ কাজ আমার রুটি-রুজি। সহকর্মীদের অবশ্যই সম্মান করা উচিৎ। তবেই তার কাছ থেকে সম্মান পাওয়া যাবে। আসলে সম্মানটা কেউ কাউকে এমনি দেয় না। সর্বশেষ আমার কথা হলো- ভালো কথাটা প্রকাশ্যে বলি, আর খারাপ কিছু হলে সেটা নিজেরা বসে (যার সঙ্গে সমস্যা) সমাধান করি- এটা না করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেই তো তার সব সমাধান হবে না! রাইজিংবিডি: পুরুষদের তুলনায় নারী নির্মাতার সংখ্যা অনেক কম। নারীরা কেন পরিচালনায় আসছে না?

চয়নিকা : ওরা (নারী) পারে না তাই কম। ওদের ধৈর্য্য নাই। অনেক নারী নির্মাতা বলেন, ‘ক্যামেরাম্যান নাটক বানিয়ে দেয়’। তারা আসলে যত্নবান না। এটা আবার সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। যেমন শ্রাবণী ফেরদৌস নামে একটি মেয়ে নতুন কাজ করছে। মেয়েটি যথেষ্ঠ ভালো কাজ করছে। রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মার্চ ২০১৮/শান্ত/তারা