বিনোদন

বৃষ্টিমুখর দিনে কালসি থেকে উত্তরা

আমিনুল ইসলাম শান্ত : কালসি থেকে যখন আমাদের বহনকারী বাসটি ছাড়ে তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি ঝরছে। মেঘে ঢাকা এই শহরের মানুষ তখন নিজ নিজ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য বেপরোয়া। বাসটি যখন মাটিকাটা ফ্লাইওভারের(জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার) ওপর ওঠে তখন ইট কাঠের এই শহরে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য খেলা করছে। বাসের জানালা দিয়ে যত দূর সবুজ দেখা যায়, তাতে যেন কোনো শিল্পী নিপুণ হাতে সতেজতার রং মেখে দিয়েছে। পাহাড় বেয়ে ওঠার মতো বাসটি ফ্লাইওভারে ওঠে এবং দ্রুতই আবার ঢাল বেয়ে নেমে যায়। বিশ্বরোড পার হয়ে বাসটি খিলক্ষেত পৌঁছানোর পর মুষল ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়। পিচঢালা পথে তখন গাড়ির সংখ্যা অনেকটাই কম। অন্যান্য গাড়ির মতো আমাদের বাসটিও সাঁ সাঁ করে ছুটে চলেছে। নগরীর উত্তরার আজমপুর বাসষ্ট্যান্ডে পৌঁছাই বেলা পৌনে বারোটার দিকে। মুষল ধারার বৃষ্টি ততক্ষণে টিপটিপ করে ঝরছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই অন্য যাত্রীদের মতো এই স্টেশনে নেমে যাই। গন্তব্য উত্তরার চার নম্বর সেক্টর।  রাস্তা পার হয়েই দ্রুত রিকশায় ওঠে বসি। বারোটার একটু পরে ৩৮ নম্বর বাড়িতে পৌঁছাই। কালো রঙের লোহার গেট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা হয় তরুণ নির্মাতা আজাদ আল মামুনের সঙ্গে। কুশল বিনিময়ের পর জানা যায়, কিছুটা মনও খারাপ এ নির্মাতার। কারণ সকাল থেকে কয়েক দফা ক্যামেরা ওপেন করেও কোনো শট নিতে পারেননি। বাইরে যখনই ক্যামেরা ওপেন করেছেন ঠিক তখনই বৃষ্টি নাকি বেরসিকভাবে নেমেছে। তাই দুপুর পেরিয়ে গেলেও একটি দৃশ্যের শুটিংও করতে পারেননি। আমাদের ‍উপরে পাঠিয়ে দিয়ে আবারো শট রেডি করতে তৎপর হয়ে উঠেন তিনি। চা-নাস্তা খেয়ে বাড়িটির ছাদে চলে যাই। গিয়ে দেখি ক্যামেরা অ্যাকশন চলছে। তবে শট এনজি হওয়াতে বার বার কাট বলতে হচ্ছে নির্মাতাকে। এজন্য কয়েক দফা রিহার্সেল চলে। ততক্ষণে সূর্যের আলো কিছুটা ফুটেছে। পাশের বিল্ডিংয়ের জানালা দিয়ে উৎসুক নারী-পুরুষ উঁকি দিচ্ছেন। তাদের ঠোঁটের ভাষা আর অভিব্যক্তি দেখে বোঝা যায় শুটিং নিয়ে জোর আলোচনাই করছেন তারা। রিহার্সেল করার পর আবারো শট এনজি। আবারো প্রস্তুতি নেয় পুরো টিম। এক পর্যায়ে শট ওকে হলে একটু তৃপ্তির হাসি হাসেন নির্মাতা। কারণ এই দৃশ্যের মাধ্যমে শুটিংয়ের ‘বিসমিল্লাহ’ করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে নির্মাতা আজাদ আল মামুন নির্মাণ করছেন ‘লেখক’ নামে একক একটি নাটক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘তারাপ্রসন্নের কীর্তি’ অবলম্বনে নাটকটির নাট্যরূপ দিয়েছেন মেজবাহ উদ্দীন সুমন। নাটকটির প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী মৌসুমী হামিদ ও এস এন জনি। দুপুর ১ টা বেজে গেলেও সেটে এসে পৌঁছাননি মৌসুমী হামিদ। কারণ নায়িকার শট দেরিতেই ছিল।  ছাদ থেকে নেমে আসি দোতলায়। এসে দেখি, ইনডোরে শটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন শুটিং টিম। এ ফাঁকেই নাটকের বিষয়ে কথা হয় নির্মাতার সঙ্গে। আজাদ আল মামুন বলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গল্পগুলোর অধিকাংশ খুব ভারী বা গাম্ভীর্যপূর্ণ হয়। কিন্তু  ‘তারাপ্রসন্নের কীতি’ গল্পটি অনেক মজার এবং একদম ভিন্ন একটি গল্প। এই গল্পটি এখন যেমন আছে এক যুগ পরেও একই থেকে যাবে। গল্পটিতে দেখা যাবে- একজন লেখালেখি করেন কিন্তু তিনি কি লিখেন তা তিনি নিজেও জানেন না। এদিকে এই লেখকের স্ত্রী সাহিত্য বোঝেন না কিন্তু তার ধারণা তার স্বামী খুব ভালো লিখে। তার লেখার মান উচ্চমার্গীয়। এজন্য সবাই তার স্বামীর লেখা বোঝে না। তার ধারণা তার স্বামী অনেক নাম করবে। একপর্যায়ে বইও প্রকাশ করে কিন্তু কোনো বই বিক্রি হয় না। এভাবে গল্প এগিয়েছে।’’ রবীন্দ্রনাথের মূল গল্পে নায়িকা মারা যায় কিন্তু এই নাটকটির গল্পে নায়িকা মারা যাবেন না। রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে চিত্রনাট্য তৈরি করা হয়েছে। চিত্রনাট্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে তৈরি করায় কস্টিউম ও সেট বর্তমান সময়ের আদলেই তৈরি করা হয়েছে। পুরো নাটকটি একটি কমেডি নাটক বলেও জানান এই নির্মাতা। কথা বলতে বলতেই সহকারী পরিচালক এসে বলেন, ‘ভাই শট রেডি।’  এ কথা শুনেই ওঠে যান নির্মাতা।  দুপুর আড়াইটা নাগাদ ঢুঁ দিই মেকআপ রুমে।  ততক্ষণে মেকআপ রুমে ঢুকে গেছেন মৌসুমী হামিদ। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখা মেলে নায়িকার। হলুদ রঙের শাড়ি পরিহিত মৌসুমী তখন চুলের খোপা বাঁধছিলেন। অল্প কথায় কুশলবিনিময় শেষে নিজেকে তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন নায়িকা। ইতোমধ্যে মেকআপ নেওয়াও শেষ। নিজের ব্যাগ থেকে টিপের পাতা বের করে কপালে কালো রঙের একটি টিপ পরে নেন। আলতাবরণ কপালে কালো রঙের টিপটি যেন রূপে অন্যমাত্রা যোগ করে। তবে বিপাকে পড়ে যান কানের দুল নিয়ে। কারণ যে দুল জোড়া পরবেন তার একটি পেলেও আরেকটি পাওয়া যাচ্ছিল না। ততক্ষণে সহকারী পরিচালক আবার মেকআপ রুমে ছুটে এসেছেন। এসেই বললেন, ‘আপা শট রেডি।’ নায়িকার সঙ্গে আমরাও চলে এলাম দ্বিতীয় তলায়। তখন বেলা ৩টা বাজে। ড্রয়িং রুমের দৃশ্য। সিঙ্গেল একটি সোফায় বসে আছেন অভিনেতা এসএন জনি। পরনে পাঞ্জাবি, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। তার পাশের সোফায় গিয়ে বসলেন মৌসুমী হামিদ। অন্য সোফায় বসে আছেন অভিনেতা আবির খান। নির্মাতা অ্যাকশন বলার আগে বেশ কিছুক্ষণ চলল রিহার্সেল। মাঝে মধ্যে রঙ্গ-তামাশা করতেও ছাড়ছেন না কলাকুশলীরা। প্রায় সাড়ে চারটার দিকে মৌসুমী হামিদ হাঁক ছাড়েন, খুব ক্ষুধা লাগছে খাবার দাও। বলেই ডাইনিংয়ে গিয়ে বসেন এ নায়িকা। দ্রুতই তাকে খাবার পরিবেশন করা হয়। তখনো আরেকটি দৃশ্যের রিহার্সেল চলছে। জনির দৃশ্যটি ভুল হচ্ছিল দেখে, খাবার মাখানো হাত নিয়েই তিনি আবার চলে যান ক্যামেরার সামনে। বৃষ্টির কারণে শুটিংয়ের বিলম্ব হওয়াতে তখনো সেটের আর কারো খাওয়া হয়নি। খাওয়া শেষ হলে নাটকের বিষয়ে কথা হয় নায়িকার সঙ্গে। এ সময় মৌসুমী হামিদ বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প অবলম্বনে নাটকটি নির্মিত হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে এটিএন বাংলায় এটি প্রচারিত হবে। গল্পটি খুব সাধারণ কিন্তু খুবই মজার। গল্পে একজন লেখকের স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করছি। আমি সাজ-গোজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও লেখক স্বামীকে নিয়ে আমি ভীষণ গর্ব করি।’ মৌসুমী হামিদের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম তখন আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দেন জনি। নাটক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এর আগেও রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে নির্মিত নাটকে কাজ করেছি। কিন্তু এই প্রথম এই ধরণের কোনো চিত্রনাট্যে কাজ করছি। কারণ নাটকটির চিত্রনাট্য একদমই আলাদা। নাটকটির মূল মেসেজ হলো- যারা উপন্যাস বোঝেন তারা কখনো উপন্যাস নিয়ে হইচই করেন না। আর যারা উপন্যাস বোঝে না তারাই মূলত হইচইটা করে থাকেন। যারা উপন্যাস বোঝে না তাদের কখনো এ বিষয়ে কথা বলা উচিৎ না। নাটকটির গল্পে এই মেসেজটাই দেয়া হয়েছে।’ গল্প আর চা পান। কথা আর হাসি। কখনো কখনো কপালের ভাঁজে ভাবনার রেখাও ছিল। এভাবেই গত রোববার কেটেছে। দিনের শুরুতে যেমন সূর্যের দেখা ছিল না। শেষ বেলাতেও কচ্ছপের মতো সূর্য নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল। বিদায় বেলাতেও তার দেখা মেলেনি। তখনো চলছে লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন…।       রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ মে ২০১৮/শান্ত/ফিরোজ