বিনোদন

মন খারাপের সময় আমি আপনার গানটা গাই

||আবদুন নূর তুষার|| আইয়ুব বাচ্চুর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। ছাত্রলীগ মেডিক্যাল কলেজ শাখার নবীনবরণ। সোলস এসেছে, আইয়ুব বাচ্চু, নকিব খান, তপন চৌধুরী, নাসিম, রনি ...। সোলস, মাদার অব ব্যান্ডস ইন বাংলাদেশ। মঞ্চে আমাকে দেখে বাচ্চু ভাই বলেন, কি ডাক্তার। আমি তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমাকে প্রথম ডাক্তার বলে ডেকেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। এরপর আর সেই ডাক কখনো বদলে যায় নাই। বাচ্চু ভাইয়ের মায়ের অসুখ, ভাইয়ের অসুখ, ওষুধ খাওয়ানোর আগে বাচ্চু ভাই আমাকে ফোন করতেন। শুভেচ্ছার দ্বিতীয় অনুষ্ঠানে গান গাইলেন বাচ্চু ভাই। সেই তুমি... প্রথম অনুষ্ঠানে মাইলসকে ডেকে আনায় তার অভিমান। কি ডাক্তার? ভাইকে বাদ দিয়ে ম্যাগাজিন বানিয়ে ফেললেন? রসিকতা করে বললেন, আমরা চাটগাইয়া তো , ইংলিশ ভালো পারি না। বলে হা হা হা করে হাসলেন। এরপর শুভেচ্ছার প্রতিটি বিশেষ অনুষ্ঠান, ঈদ এবং প্রতি চারমাসে একবার বাচ্চু ভাই গান গাইতেন। তার সলো বের হলো, ‘কষ্ট’। ঈদের অনুষ্ঠান শুভেচ্ছায় তিনি গাইলেন। আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি, উড়াল দেবো আকাশে, হাসতে দেখো গাইতে দেখো, সুখেরি পৃথিবী, নির্ঘুম রাত, ঘুম ভাঙ্গা শহরে, দরজার ওপাশে, সাড়ে তিনহাত মাটি, বাংলাদেশ.... কত যে গান। বিপাশার জন্য শচীনের গান ট্র্যাক করে দিলেন। শুভেচ্ছার ঈদ অনুষ্ঠান, আনন্দমেলার টাইটেল। বাচ্চু ভাইয়ের এবি কিচেনের চটপটি আর ফুচকা, তার সাথে বিকেলের আড্ডা। শুভেচ্ছা জোর করে বন্ধ করে দেয়ার পর তার কষ্ট কে দেখে? আমাকে বললেন, আপনার জন্য বাচ্চু সারাজীবন থাকবে। সত্যি ছিলেন তিনি। তার কালো লেভিন আর আমার পুরোনো স্টারলেট দিয়ে ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়েতে পাল্লা দেয়া। গাড়ি থেকে নুরজাহানে নেমে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, মেরেই তো ফেলতেন আমাকে আরেকটু হলে। চাটগাইয়া ভাষায় বললেন, ‘অনর বাংগা গারির শিনার জোর আছে।’ বাচ্চু ভাইয়ের সাথে একাধিকবার আমি মঞ্চে হাসতে দেখো গাইতে দেখো গেয়েছি। এটা গাওয়ার সময় তিনি যদি জানতেন আমি দর্শক সারিতে আছি তবে আমাকে মঞ্চে ডাকতেন-ই। একসাথে জাপান, ইতালি, দুবাইয়ে অনুষ্ঠান করতে গেছি। জাপানে এক গিটারের দোকানে ঢুকতেই দোকানি আমাদের পাত্তা না দিয়ে অন্য ক্রেতার সাথে কথা বলছিল। বাচ্চু ভাই বিনয়ের সাথে বললেন, মে আই প্লে দিস গিটার? গিটারে বেজে উঠল জিমি হেনড্রিক্স, নফলার ব্রাদার্স আর সান্টানার সুর। তারপর গিটার আর থামে না। শেষে এরিক ক্ল্যাপটন। দোকানের বাইরে ভিড়। কয়েক শ লোক। বাচ্চু ভাই বাজিয়ে দিলেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। গিটারের দোকানি বাচ্চু ভাইকে জড়িয়ে ধরে আর ছাড়ে না। দোতলায় নিয়ে তার দোকানের সব গিটার তাকে মেলে ধরে বলে একটা নিয়ে যাও। যে দাম খুশি সে দাম দাও। আমি খুশিতে চোখ ভিজিয়ে ফেলেছিলাম। বিদেশে গেলে আমাকে সাথে নিয়ে সবখানে ঘুরতেন। বলতেন ডাক্তার সাথে থাকলে আমি সেফ, বিপদ নাই। তার মায়ের চিকিৎসাতে আমার খানিকটা ভূমিকা থাকাতে তিনি বারবার সেই কথা বলতেন। গেলাম ইতালি। সেখানে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ইতালিয়ান শ্বেতকায়। সে কোনো কথা বোঝে না। সাউন্ড চেকে বাচ্চু ভাই গেয়ে ফেললেন পরপর- মানি ফর নাথিং, সালটান অব সুইং, ওয়াক অফ লাইফ আর বিউটিফুল টুনাইট। তারপর সাউন্ডের লোক আর তার পিছু ছাড়ে না। আমি হাসি। মাসুদ আর স্বপন ভাই হাসে আর বলে বস ইজ বস। টুটুল এল আর বি ছেড়ে দেয়ায় খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। এরপর এল আর বি-তে কেউ কীবোর্ড বাজায় নাই। তিনি বলতেন সে চলে গেছে যাক, তার জায়গা কাউকে দেব না। তাকে কয়েকজন গানের শিল্পী বারবার কষ্ট দিয়ে কথা বলেছেন। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, কি করব ডাক্তার। সব তো সন্তানের মতো। আমি বলেছিলাম, ধৈর্য্য ধরেন। তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন, কিছুই বলেন নাই, ধৈর্য্য ধরেছিলেন। বাচ্চু ভাইয়ের সাথে মাদক বিরোধী কনসার্ট, ক্যানসার সোসাইটির কনসার্ট, বাংলাদেশের ক্রিকেট কনসার্ট, আর্মি স্টেডিয়াম আর ইনডোর স্টেডিয়ামে, শুভেচ্ছার ঈদ অনুষ্ঠান, চট্টগ্রামে স্টেডিয়ামে সিনটিলার কনসার্ট, মেডিক্যাল কলেজের অ্যালামনাই ডে তে কনসার্টে বিরাট শব্দে স্পিকারে ডাক্তার শব্দটা শুনবই। একবার বাচ্চু ভাই ব্যাংকক এয়ারপোর্টে সবাইকে ফল কিনে খাওয়াচ্ছেন। কি ব্যাপার ভাইজান? বলেন পকেটে এতগুলো টাকা, কোথায় খরচ করব? তাই সবাইকে ফল খাওয়াচ্ছি। একটু পরে এসে বলেন, ডাক্তার মা চলে যাওয়ার পর সব অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছি। সেজন্যই টাকা শেষ হচ্ছে না। কিছুদিন বাচ্চু ভাই সিগারেটও খান নাই। বাচ্চু ভাই, আপনার প্রায় সব গান আমার মুখস্থ। আপনার গান, আজম খানের গান, মাকসুদ ভাই, মাইলস, ফীডব্যাক, সোলস আমার বড় হওয়ার সঙ্গী। মন খারাপের সময় আমি আপনার গানটা গাই, আমার আরেক ভাই আসিফ ইকবালের লেখা... বহুদূর যেতে হবে

এখনো পথের অনেক রয়েছে বাকি

ভালোবাসায় বিশ্বাস রেখো

হয়তো অচেনা মনে হতে পারে আমাকে তুমি ভয় পেওনা

তুমি থেমে যেওনা তুমি ভয় পেওনা।

বহুদূর যাত্রা করেছেন ভাই আমার।

ভয় পাবেন না। এত কোটি মানুষকে জীবনে আনন্দ আর বেদনার সময় গান গেয়ে ভালো রেখেছেন তাদের দোয়া আপনাকে বহুদূরের সেই দেশে ভালো রাখবেই। বেঁচে থাকলে প্রিয়বিয়োগের বেদনা হবেই। আপনার না থাকার বেদনা বাকি সময় বহন করতেই হবে আমাকে। আামি এখনো আপনার গান শুনছি। বহুদূর যেতে হবে। ভালোবাসা। লেখাটি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষারের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেওয়া।  

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ অক্টোবর ২০১৮/শান্ত/মারুফ