বিনোদন

‘ফাগুন হাওয়ায়’ একটি চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র বা ইতিহাস নয়

তিনি অভিনয়শিল্পী থেকে চলচ্চিত্রনির্মাতা। আশির দশকে টেলিভিশন নাটকে তার অভিনয় দর্শককে মুগ্ধ করেছে। ছোট পর্দায় অভিনয়ের পাশাপাশি বড় পর্দায় অভিনয় করেও দর্শক হৃদয় হরণ করেছেন; এখনও করছেন। পাশাপাশি নির্মাণ করেছেন দর্শকপ্রিয় নাটক, টেলিফিল্ম এবং চলচ্চিত্র। তৌকীর আহমেদ পরিচালক হিসেবেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। তার পরিচালনায় ষষ্ঠ সিনেমা ‘ফাগুন হাওয়ায়’। ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মিত সিনেমাটি আজ ৫২টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। সিনেমাটি নির্মাণের গল্প তিনি শুনিয়েছেন আমিনুল ইসলাম শান্তকে। তাদের কথোপকথন পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।  রাইজিংবিডি: স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও ভাষা আন্দোলন নিয়ে সিনেমা নির্মিত হয়নি। এত বছর পর এই বিষয়টি আপনি কেন বেছে নিলেন? তৌকীর : আমার মনে হয়- একটি জাতিকে তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিকে তাকাতেই হবে। বাঙালি জাতির জীবনে ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। ওই সময় ধরেই আমি কাজ করতে চেয়েছি এবং এই প্রজন্মের কাছে ওই গল্পটা পৌঁছে দিতে চেয়েছি। তবে এটাও সত্যি যে, এই সিনেমা কোনো তথ্যচিত্র না, বা ইতিহাসের কোনো পার্টও না। মফস্বলে ঘটে যাওয়া একটি ফিকশন। যেটি রূপকভাবে ভাষা আন্দোলনকে স্পর্শ করবে। রাইজিংবিডি : এতে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট কতটা তুলে আনতে পেরেছেন? তৌকীর : এটা আপনি সিনেমা দেখেই বলুন। এ বিষয়ে আমি বয়ান দিব না। সিনেমা দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন বিষয়টি আমি কীভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা ধরেন তবে দেখবেন- বিষয়টি নিয়ে অনেক সিনেমা নির্মিত হয়েছে। একেকটা সিনেমায় বিষয়টি একেকভাবে উঠে এসেছে। চলচ্চিত্র একটি স্বতন্ত্র শিল্প মাধ্যম। যেখানে শিল্পরূপ, ভাবনা অবশ্যই একটি ইতিহাস বইয়ের মতো না, কিংবা তথ্যচিত্রের মতো না। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ আমার কাছে একটি চলচ্চিত্র। এতে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট কতটা উঠে এসেছে, আদৌ আমি ভাষা আন্দোলনকে স্পর্শ করতে পেরেছি কিনা, ভাষা আন্দোলনের সেই চেতনা আপনাকে স্পর্শ করছে কিনা- সেটা আপনি দেখেই বলুন! রাইজিংবিডি : বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এ আন্দোলন-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনও বটে। আপনি কি বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পেরেছেন? তৌকীর : যেহেতু ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে সিনেমা, সেহেতু সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কর্তৃত্ব তো কিছুটা হলেও থাকবে। আপনি ’৫২-এর গল্প বানালে তাতে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির বিষয় তো আসবেই। কিন্তু এতে কেউ যদি ইতিহাস দেখতে চান তবে আমি বলব- ভুল হবে। কারণ এটি একটি ফিল্ম। এতে আমরা একটি গল্প বলেছি। আমার ধারণা সেখানে যথেষ্ঠ এন্টারটেইনিং রয়েছে। প্রেম আছে, আনন্দ আছে, তরুণদের দুরন্তপনা আছে, দেশপ্রেমের বিষয়টিও আছে। এসব মিলিয়েই একটি চলচ্চিত্র ‘ফাগুন হাওয়ায়’। রাইজিংবিডি : টিটু রহমানের ‘বউ কথা কও’ গল্পের অনুপ্রেরণায় সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন। এই গল্পটি কেন বেছে নিলেন? তৌকীর : আমার মনে হয়েছে, এটি সুন্দর একটি গল্প। রূপকভাবে ভাষা আন্দোলনের বিষয়টি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। অনেক দিন আগে গল্পটি যখন পড়ি তখন আমার মনে হয়েছিল, এটি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যেতে পারে। একটাই সমস্যা তা হলো-গল্পটি খুব ছোট। গল্পের মূল বিষয়টি ঠিক রেখে আমরা পরিবর্তন করেছি। সিনেমার প্রয়োজনে সেরকম কিছু চিত্রনাট্য তৈরি করে নিয়েছি। ভাষা আন্দোলনের মূল বিষয়টি এই গল্পে সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই ভালো লাগা থেকেই মূলত গল্পটি বেছে নিয়েছি। রাইজিংবিডি : ইতিহাস নির্ভর সিনেমার ক্যানভাস যেমন বড় হয় তেমনি আয়োজনটাও বড় পরিসরে করতে হয়। এ ক্ষেত্রে আপনি কোনো সংকটে পড়েছিলেন কিনা? তৌকীর : আমাদের খুব সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়। এক্ষেত্রে বাজেটের বিষয়টি মূল। বাজেট কম থাকলে তখন সব দিক থেকেই সংকুচিত হতে হয়। তারপরও কম বাজেটের মধ্যে চেষ্টা করেছি সেই সময়টা তুলে ধরতে। সেই সময়ের বিস্তারিত বিষয়গুলো তুলে আনতে। পোশাক, গাড়ি-ঘোড়া, ঘর-বাড়ি, ব্যবহার্য জিনিসপত্র এসব কিছুর আয়োজনের মধ্য দিয়ে ওই সময়টা তুলে আনার চেষ্টা করেছি। সীমাবদ্ধতা তো থাকবেই তার মধ্য দিয়েই তো কাজ করতে হবে। রাইজিংবিডি : আপনি বাজেটের সংকটের কথা বলেছেন। এছাড়া অন্য কোনো সংকট… তৌকীর : বাজেট থাকলে আর কিছু লাগে না। এটা হলে সব কিছুর সমাধান হয়ে যায়। যখন বাজেট কম থাকবে তখন স্বল্প সময়ে দ্রুত কাজ করতে হবে। এটার সংকট হলে তার প্রভাব সবকিছুতেই ছড়িয়ে পড়বে। রাইজিংবিডি : সিনেমাটিতে পাত্রপাত্রীদের পারফরম্যান্স ও আপনার নির্মাণশৈলী- সবকিছু মিলিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী? তৌকীর : পাত্রপাত্রীদের বিষয়ে বলব- তারা খুব পরিশ্রম করেছেন, ভালো পারফরম্যান্স করেছেন। সিনেমাটির বেশির ভাগ অভিনয়শিল্পী খুব দক্ষ। আবুল হায়াৎ থেকে শুরু করে তিশা, সিয়াম পর্যন্ত। অন্যদিকে যশপাল শর্মা, রওনক হাসান, সাজু খাদেম, ফজলুর রহমান বাবু, শহীদুজ্জামান সেলিম, নরেশ ভূইয়া, ফারুক আহমেদসহ সবাই স্ব স্ব জায়গায় পরীক্ষিত। এরা সবাই যার যার চরিত্রটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। আর নির্মাণের ক্ষেত্রে আমি ভালো একটি সিনেমা নির্মাণের চেষ্টা করেছি। বাকিটা আপনারাই বলবেন। রাইজিংবিডি : আপনার নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘জয়যাত্রা’। এটিও ইতিহাস নির্ভর। আপনি নির্মাণের ক্ষেত্রে ইতিহাস নির্ভর গল্প নিয়ে তুলনামূলক বেশি কাজ করছেন। এটা কেন? তৌকীর : এই সিনেমাটিতে মুক্তিযুদ্ধের একটি অধ্যায় তুলে ধরা হয়েছে। এদেশের সাধারণ মানুষের ত্যাগ সিনেমাটিতে তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের উপর নানা আঙ্গিকে সিনেমা নির্মিত হয়েছে। কেউ ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ নির্মাণ করেছেন, কেউ ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নির্মাণ করেছেন। সুতরাং ভাষা আন্দোলন নিয়েও আরো অনেক সিনেমা নির্মিত হবে। একেকজন একেকটি গল্প তুলে ধরবেন। ভাষা আন্দোলনের সিনেমা মানেই ভাষা আন্দোলনকেই তুলে ধরা হবে সেটা ঠিক হবে না। রাইজিংবিডি : সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে ইতিহাস নির্ভর গল্প নির্বাচন আপনার তুলনামূলক বেশি পছন্দ। এটা আমার প্রশ্ন ছিল… তৌকীর : একটি জাতির অর্জনগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। সেদিকে ফিরে তাকাতে হবে। নতুন প্রজন্মের সামনে সেগুলো নিয়ে আসতে হবে। একটি উন্নত জাতি সব সময় তার ইতিহাস মনে রাখে। আর সব সিনেমা যে আমি ইতিহাস নির্ভর করি তা কিন্তু না। আমার নির্মাণের তালিকায় হালদা, অজ্ঞাতনামা, রূপকথার গল্পও রয়েছে। সুতরাং বিভিন্ন ধরণের গল্প নিয়েই আমি কাজ করি। তবে অনেক দিন পর ইতিহাস নির্ভর গল্প নিয়ে কাজ করলাম। রাইজিংবিডি : ইদানিং অনেক পরিচালককে বলতে শোনা যায়- দেশের জন্য নয়, দেশের বাইরের উৎসবগুলোতে প্রদর্শনের জন্য সিনেমা নির্মাণ করছি। এ বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন? তৌকীর : আমি অন্যের বক্তব্য নিয়ে বক্তব্য দিতে পারব না। তবে আমার বিষয়ে আমি বলব, আমি চাই দর্শক সিনেমা দেখুক। দর্শক তার সমালোচনা করুক, প্রশংসা করুক। তারপর সিনেমা যদি বিদেশে যায়, পুরস্কৃত বা প্রশংসিত হয় সেটা আরো ভালো। বাংলা সিনেমাকে বিশ্বের দরবারেও নিয়ে যেতে হবে। এই সিনেমার কথাই যদি বলি, আমি চাইব- এটি বিদেশে প্রদর্শিত হোক। আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসটা বিদেশিদের সামনে উপস্থাপিত হোক। কিন্তু যেমনটা প্রশ্ন করলেন তেমন কোনো দৃষ্টিভঙ্গি আমার নেই। রাইজিংবিডি : নতুন কোনো সিনেমার পরিকল্পনা করেছেন কিনা ? তৌকীর : আমার কিছু গল্প তৈরি আছে। তবে সেগুলো নিয়ে সিনেমা নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা এখানো করি নি। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ মুক্তির পর এসব নিয়ে ভাববো। রাইজিংবিডি : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। তৌকীর : আপনাকেও ধন্যবাদ। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/শান্ত/তারা