বিনোদন

সুফিয়া সকল মায়েদেরই প্রতিচ্ছবি

আমিনুল ইসলাম শান্ত: সুফিয়ার পরিবারে আর কেউ নেই। ছোটবেলা থেকেই অন্যের বাসায় কাজ করে, আজ এ বাসা তো কাল অন্য বাসায়। গায়ে হলুদ, বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও কাজ করে সে। ভালোই কাটছিল তার জীবন। পাশের পাড়ার ইলেকট্রিক মিস্ত্রী হারুন পছন্দ করে সুফিয়াকে। প্রেমিক হারুন প্রেমিকাকে ইমপ্রেস করার জন্য নানা কর্মকাণ্ড করে থাকে। ধীরে ধীরে সুফিয়ার মনে ভালোবাসার জন্ম হয়। প্রতিদিন কাজ শেষে ঘোরাঘুরি, ফুসকা খাওয়া, গল্প করা, হাত ধরে ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকা— বেশ জমে উঠে তাদের প্রেম। এরপর বিয়ে করে হারুন-সুফিয়া। হারুনের বাবা নেই, মা আছে। দুই সদস্যের সংসারে পা রাখে সুফিয়া। নিম্নবিত্ত পরিবারে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের দৃশ্য নিত্যদিন উঁকি দিতে থাকে। হারুন তার মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে।

এদিকে হারুন-সুফিয়ার কোলজুড়ে এক কন্যাসন্তান আসে। তার নাম রাখে রাফিয়া। মেয়ে জন্মের পর বিষয়টি ভালোভাবে নেয় না হারুন। বরং সে বিরক্ত হয়। তার সন্তানের প্রতি ভালোবাসার কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। কিন্তু রাফিয়াকে ঘিরেই সুফিয়া স্বপ্ন বুনতে থাকে। তার লক্ষ্য, মেয়েকে যেন মায়ের মতো মানুষের বাড়িতে কাজ না করতে হয়। যাতে ওর ভবিষ্যত আর দশটা শিক্ষিত মানুষের মতো হয়। গোপনে মেয়ের জন্য ডিপিএস করে সুফিয়া। ডিপিএসে টাকা জমা আছে তা জানতে পারে হারুন। তারপর ডিপিএস ভেঙে ইলেকট্রিকের দোকান দিতে চায় সে। কিন্তু তাতে রাজি হয় না সুফিয়া। টাকা না পেয়ে সুফিয়াকে মৌখিকভাবে তালাক দেয় হারুন। রাফিয়াকে নিয়ে জীবনযুদ্ধ শুরু করে সুফিয়া। ধীরে ধীরে মেয়ে বড় হয়ে একদিন চিকিৎসক হয়। এর মধ্যে সুফিয়া মারা যায়। মাকে দেয়া কথা অনুযায়ী, বাবাকে খুঁজে বের করে রাফিয়া।

এই গল্প নিয়ে পরিচালক সরদার রোকন নির্মাণ করেছেন একক নাটক ‘মায়েরা পাখির মতো হয়’। এটি রচনা করেন দয়াল সাহা। হারুণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন আব্দুন নূর সজল। আর সুফিয়া ও রাফিয়া চরিত্রটি রূপায়ন করেছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। গত ঈদুল ফিতরে এটি চ্যানেল আইতে প্রচার হয়েছে।

সুফিয়া-হারুনের মতো প্রেমিক যুগল, সুফিয়া-হারুনের মতো বাবা-মা, রাফিয়ার মতো মেয়ে, সুফিয়া-হারুন-রাফিয়ার মতো নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের সঙ্গে প্রত্যাহ আমরা ফুটপাত ধরে হেঁটে যাই। পাশাপাশি বসবাস করি। এই তিনটি চরিত্র আমাদের সমাজের বড় একটি অংশের। তাদের গল্প আমাদের চিরচেনা। খুব সাধারণ কিন্তু কঠিন এক বাস্তবতা দিনের পর দিন তারা বয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের সমাজের অনেক সুফিয়া-হারুন বয়স এবং আবেগে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু বাস্তবতা দরজায় কড়া নাড়লে জীবনের সবকিছু ফিকে হয়ে যায়। তারপর একজন মাকে জীবন ভর সন্তানের দায়িত্ব ও তার প্রতি ভালোবাসার ঘানি টেনে বেড়াতে হয়। অর্থ না থাক, শরীর ন্যুজ হয়ে যাক তবু মায়ের ভালোবাস হারিয়ে যায় না। নাড়ি ছেঁড়া ধনের মায়া মা ত্যাগ করতে পারেন না। সন্তানকে নিয়ে কোথাও ঠাই না পেলেও তাকে বুকে আগলে পাখির মতো উড়ে বেড়ান এক ডাল থেকে অন্য ডালে। প্রতিনিয়ত প্রাণপণে চেষ্টা করেন তার সন্তানকে দুধেভাতে রাখতে। এটা সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসছে। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে মায়েদের এই চিত্র চিরঅমলিন। সুফিয়া, রাফিয়া ও হারুনের মতো মানুষের জীবন এতটা কাছ থেকে দেখেও আমরা কখনো হয়তো ভাবি না। ভাবি তখন যখন তা রুপালি পর্দা কিংবা বইয়ের পাতায় স্থান পায়। খুব সাধারণকে যখন অসাধারণভাবে চোখের সামনে তুলে ধরা হয়। সেই অসাধারণ কাজটি সফলভাবে করেছেন নাট্যকার, নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী ও কুশলিরা।

এমন একটি গল্প পর্দায় তুলে আনার জন্য প্রথম প্রচেষ্টা একজন নাট্যকার করে থাকেন। এজন্য তার ভাবনাকে সাধুবাদ জানাই। তবে নাট্যকার চিত্রনাট্য রচনায় আরো কৌশলী হলে ভালো হতো। গল্প বলার ঢং অর্থাৎ চিত্রনাট্য যেভাবে সজানো হয়েছে তা খুব ভালো হয়নি। কারণ গল্প যেভাবে শুরু হয়েছে তাতে দর্শক পরবর্তী দৃশ্যের জন্য অধীর আগ্রহে নাও বসে থাকতে পারেন। এজন্য আমার ধারণা, গল্পে আরো নাটকীয়তা প্রয়োজন ছিল। দক্ষতার সঙ্গে অভিনয়শিল্পীদের পারফর্ম অনেক কিছু উতরে গেছে। বিশেষ করে প্রথম দৃশ্যে— জানালা দিয়ে তিশা যখন সজলকে দেখে তখন তার চোখ ছলছল হয়ে যায়। প্যারালাইজড সজল হুইল চেয়ারে বসে শার্ট টেনে নামানোর চেষ্টার দৃশ্য। দীর্ঘ দিন পর সজল-তিশার (বাবা-মেয়ের) সাক্ষাতের সময় অকৃত্রিম ভালোবাসার যে অভিব্যক্তি তা নাটকটির শুরুতে দর্শকদের নিজ নিজ আসনে শক্ত করে বসিয়ে রাখবে। ফ্লাশব্যাকে গিয়ে দেখায়— সজল-তিশার প্রেমের দৃশ্য। যেমন: একটি দৃশ্যে— তিশা এক বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তাকে একঝলক দেখার পর একটি পায়রা উড়িয়ে দিয়ে সজল যে অভিব্যক্তি দেখিয়েছেন তা যেকোনো প্রেমিকের মনে প্রেম উসকে দিবে। সজল-তিশার এমন অনেক পারফর্ম রয়েছে যা প্রশংসার দাবি রাখে।

একটি দৃশ্যে নৌকায় শুয়ে থাকেন সজল-তিশা। এতে তাদের পোশাক ও দৃশ্যকল্পের জন্য পরিচালক বাহবা পেতেই পারেন। তাছাড়া কান্ডারীর দায়িত্ব নিয়ে পরিচালক সাবলীলভাবে গল্পটি এগিয়ে নিয়েছেন। তবে সজলের সঙ্গে মেয়ে তিশার যখন দেখা হয় তখন সজলের মেকআপ ঠিক ছিল না। কারণ সজলকে আরো বৃদ্ধ দেখানো উচিৎ ছিল। সজলের মেকআপের কারণে বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদেরকে বাবা-মেয়ে মনে হয়নি। যতটুকু মেকআপ করানো হয়েছিল তাও যদি পরিপূর্ণতা পেত তবে এই প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু সজলের অভিনয় দক্ষতার কারণে তা উতরে গেছে। একজন নির্মাতার শক্তি অনেক। সে চাইলে জীবিতকে মৃত করতে পারেন। আবার কুমারীকে মা বানাতে পারেন। সুতরাং নাটকটিতে সজলের মেকআপের ত্রুটির ক্ষেত্রে পরিচালক বেখেয়ালিপনা করেছেন। যদিও এটা খুব সুক্ষ্ম ভুল। যা সহজেই দর্শকের দৃষ্টি এড়াতে পারে আবার নাও পারে। যদি দর্শকের দৃষ্টি না এড়ায় সেক্ষেত্রে যেকোনো নির্মাণ পণ্ডশ্রম হতে পারে। এজন্য প্রপস থেকে শুরু করে পোশাক, চুলের কাট (এক দৃশ্য থেকে পরের দৃশ্যর মিল রেখে), বয়স (চিত্রনাট্য অনুযায়ী), মেকআপ (চিত্রনাট্য অনুযায়ী) সহ টুকিটাকি যেসব বিষয় রয়েছে সেসব বিষয়ে নজর দেওয়াটা জরুরি। যা নির্মাণে অন্যমাত্রা যোগ করতে পারে।

কিছুদিন আগে কলকাতা থেকে ফিরে এক তরুণ নির্মাতা বললেন, ‘কলকাতায় গিয়ে ট্রামে চড়েছিলাম। তখন দেখলাম, ট্রামে বসে এক লোক বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটক দেখছেন। এ দৃশ্য দেখে বুকটা ভরে যায়।’ আমাদের টেলিভিশন নাটক নিয়ে নেতিবাচক কথা বললে মহাকাব্য রচনা করা যাবে কিন্তু বলা শেষ হবে না। কিন্তু শত ভিড়ের মধ্যেও ভালো নাটক নির্মিত হচ্ছে। যা আমাদের আশা জাগায়। ‘মায়েরা পাখির মতো হয়’ নাটকটিও আশার আলোরই একটি স্ফুলিঙ্গ।

আইরিশ ঔপন্যাসিক, নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট। তার ‘ওয়েটিং ফর গডো’ নাটকে ভ্লাদিমির আর এস্ট্রাগণের সময়-যাপনের নিরর্থক খেলা আর কথোপকথনের মধ্যে সুতীক্ষ্ণ গালি হিসেবে উচ্চারিত হয় ‘সমালোচক’ শব্দটি। আসলে ‘সমালোচনা’ ও ‘সমালোচক’ দুটি শব্দই খুব অপ্রিয়। তারপরও সমালোচনা স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে। ‘সমালোচনা’ শব্দটি অপ্রিয় জেনেও উপরের কথাগুলো দেখা ও উপলদ্ধি থেকে লেখা।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৯/শান্ত/ফিরোজ