বিনোদন

জুলাই মাসে যাদের হারিয়েছে চলচ্চিত্রাঙ্গন

রাহাত সাইফুল : অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব ঢাকাই চলচ্চিত্রের যাত্রা লগ্নে জড়িত ছিল। তাদের মধ্যে অনেককে হারিয়েছে চলচ্চিত্রাঙ্গন। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া নিয়তির এক অমোঘ নিয়ম। মৃত্যুজনিত শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়।

তবুও চিরাচরিত নিয়মে বিভিন্ন বছরে এই জুলাই মাসে আমরা চিরতরে হারিয়েছি অনেক গুণী অভিনয়শিল্পীকে। প্রয়াত গুণীদের স্মরণে আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদন।

বুলবুল আহমেদ : ঢাকাই চলচ্চিত্রের মহানায়ক বুলবুল আহমেদ। ২০১০ সালের ১৫ জুলাই তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। বুলবুল আহমেদ অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয় করেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকগুলো হচ্ছে- ‘বরফ গলা নদী’, ‘মালঞ্চ’, ‘ইডিয়েট’, ‘মাল্যদান’, ‘বড়দিদি’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’। তার অভিনীত সর্বশেষ টিভি নাটক ছিল ২০০৯ সালে ‘বাবার বাড়ি’। ১৯৭৩ সালে আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমামের (ইউসুফ জহির) ‘ইয়ে করে বিয়ে’র মাধ্যমে প্রথম সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন। এর পরে ‘অঙ্গীকার’, ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, ‘দেবদাস’, ‘মহানায়ক’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘সূর্য্ কন্যা’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘জীবন নিয়ে জুয়া’, ‘রূপালী সৈকতে’, ‘বধূ বিদায়’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দ্য ফাদার’ সহ অনেক জনপ্রিয় সিনেমার নায়ক ছিলেন তিনি। বুলবুল আহমেদ অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল ‘দুই নয়নের আলো’।

রহমান : সাদা-কালো চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা রহমান। ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশাম পরিচালিত ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অভিষেক ঘটে আব্দুর রহমানের। ১৯৫৯ সালে সিনেমাটি মুক্তি পায়। এরপরে ‘উত্তরণ’, ‘তালাশ’, ‘চান্দা’, ‘জোয়ার ভাটা’ ও ‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রে তার বিপরীতে অভিনেত্রী শবনম। এই জুটি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রথম জনপ্রিয় ও সার্থক জুটি। ১৯৬৫ সালের ১৬ এপ্রিল মুক্তি পায় ‘বাহানা’। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জহির রায়হান সিনেমাটি নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্র ব্যাপক জয়প্রিয়তা এনে দেয় নায়ক রহমানকে। এর আগে রহমান অভিনীত চলচ্চিত্র ‘মিলন’ ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল তৎকালীন দুই পাকিস্তানে। অভিনয়ের পাশাপাশি রহমান বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম নায়ক, যিনি ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ানোর সাহস দেখান। ১৯৬৭ সালে ‘দর্শন’ চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে পরিচালনায় আসেন তিনি। তার পরিচালিত উর্দু চলচ্চিত্র হলো ‘দর্শন’, ‘কঙ্গন’, ‘যাহা বাজে সেহনাই’ ইত্যাদি। আর বাংলা চলচ্চিত্র ‘নিকাহ’।

বাংলা, উর্দু ও পশতু ভাষার চলচ্চিত্রে সমানভাবে জনপ্রিয় অভিনেতা রহমান অভিনীত উল্লেখ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো উর্দুতে ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘মিলন’, ‘বাহানা’, ‘ইন্ধন’, ‘দর্শন’, ‘জাহাঁ বাজে সেহনাই’, ‘গোরি’, ‘প্যায়াসা’, ‘কঙ্গন, ‘দোস্তি’, ‘নাদান’; বাংলায় ‘এ দেশ তোমার আমার’, ‘রাজধানীর বুকে’, ‘এই তো জীবন’, ‘হারানো দিন’, ‘যে নদী মরু পথে’, ‘জোয়ার ভাটা’, ‘দেবদাস’।

দিলদার : ঢাকাই চলচ্চিত্রের তুমুল জনপ্রিয় কমেডি অভিনেতা দিলদার। ২০০৩ সালের ১৩ জুলাই ৫৮ বছর বয়সে তিনি জীবনের মায়া কাটিয়ে চিরদিনের মতো পৃথিবী ত্যাগ করেন। ১৯৭২ সালে ‘কেন এমন হয়’ নামের চলচ্চিত্র দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু করেন দিলদার। আর পেছনে ফিরে তাকাননি তিনি। অভিনয় করেছেন ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ‘বিক্ষোভ’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘কন্যাদান’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘সুন্দর আলীর জীবন সংসার’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘শান্ত কেন মাস্তান’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় সব চলচ্চিত্রে।

আমির হোসেন বাবু : জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্য পরিচালক আমির হোসেন বাবু। ২০০৩ সালের ৯ জুলাই না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। আশি ও নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় গানগুলোর নৃত্য পরিচালনা করেছেন তিনি।

ফিরোজ ইফতেখার : চলচ্চিত্র অভিনেতা ফিরোজ ইফতেখার ২০০৩ সালের ৯ জুলাই না ফেরার দেশে চলে যান। ঢাকাই চলচ্চিত্রের বেশ কিছু সিনেমায় তিনি অভিনয় করেন।

আব্দুল আলী লালু : ‘কইনচাইন দেহি’ খ্যাত এ এফএম আব্দুল আলী লালু। তিনি ২০০৯ সালের ২১ জুলাই না ফেরার দেশে চলে যান। আশির দশকে প্রয়াত ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের তুমুল জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতার একজন আব্দুল আলী লালু। বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেন।

আব্দুল করিম খান : ঢাকাই চলচ্চিত্রে অতি পরিচিত মুখ আব্দুল করিম খান। তিনি অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। একটা সময় প্রায় সব সিনেমায় ছোট ছোট চরিত্রে তার দেখা মিলতো। ২০০৯ সালের ২২ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

নূর মির্জা : চলচ্চিত্রের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নূর মির্জা। ২০১১ সালের ৩০ জুলাই না ফেরার দেশে চলে যান তিনি।

আমিনুল হক : চলচ্চিত্র্র অভিনেতা আমিনুল হক। তিনি ২০১১ সালের ৩১ জুলাই না ফেরার দেশে চলে যান।

শামসুউদ্দিন টগর : ঢালিউডের সফল চলচ্চিত্র পরিচালক শামসুদ্দিন টগর। ২০১২ সালে ২৩ জুলাই ৬৮ বছর তিনি মারা যান। সত্তর ও আশির দশকের জনপ্রিয় নায়িকা শাবানা অভিনীত ‘বানজারান’ সিনেমার কথা এখনো মনে আছে অনেকের। এতে শামসুদ্দিন টগরের গাওয়া একটি গান ‘আমরা তো বানজারান দেখাবো নাচ গান’ এখনো জনপ্রিয়। তার পরিচালিত ব্যবসাসফল সিনেমার মধ্যে আরো আছে- ‘কার বউ’, ‘মহেশখালীর বাঁকে’, ‘আখেরী নিশান’, ‘হুর এ আরব’, ‘যুবরাজ’, ‘গলি থেকে রাজপথ’, ‘দখল’, ‘সম্রাট’, ‘রাজ ভিখারী’, ‘নকল শাহজাদা’ ইত্যাদি।

সৈয়দ আক্তার আলী : প্রবীণ অভিনেতা ও পরিচালক সৈয়দ আখতার আলী ৭৫ বছর বয়সে ২০১৩ সালের ২২ জুলাই না ফেরার দেশে চলে যান। ‘নদী ও নারী’ সিনেমার মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্রে পদার্পণ করেন। এরপর অভিনয় করেন অসংখ্য সিনেমায়। তিনি ‘নাবালক’ নামে একটি সিনেমা পরিচালনাও করেন।

মনির হোসেন বুলেট : চলচ্চিত্র অভিনেতা মনির হোসেন বুলেট। তিনি ২০১৫ সালের ১ জুলাই না ফেরার দেশে চল যান। বেশ কিছু সিনেমায় তিনি খল চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

পাপিয়া সেলিম : ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ২০১৭ সালের ৮ জুলাই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে যান। তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।

রাতিন : মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের গুণী অভিনেতা আবদুর রাতিন ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই ৬৬ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে লিভার ও কিডনিজনিত রোগে ভোগেন। শতাধিক মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন রাতিন। ১৯৭২ সালে টেলিভিশন নাটকে অভিনয় শুরু করেন। দুই শতাধিক টেলিভিশন নাটকে তাকে দেখা গেছে। রাতিন অভিনীত উল্লেখযোগ্য টেলিভিশন নাটক হলো ‘রত্মদ্বীপ’, ‘মহুয়ার মন’, ‘অভিনেতা’, ‘বোবা কাহিনি’, ‘গৃহবাসী’ প্রভৃতি। ১৯৭০ সালে ‘নতুন প্রভাত’ সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে। নতুন প্রভাত সিনেমা পরিচালনা করেন মোস্তফা মেহমুদ। রাতিন অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমা হলো ‘হারানো সুর’, ‘দেবদাস’, ‘শুকতারা’, ‘জবাব চাই’, ‘স্নেহের প্রতিদান’, ‘লালু সর্দার’ প্রভৃতি।

রানী সরকার : জনপ্রিয় অভিনেত্রী রানী সরকার ২০১৮ সালের ৭ জুলাই না ফেরার দেশে চলে যান। ৮৬ বছর বয়সি এই অভিনেত্রী বার্ধক্য ছাড়াও পিত্তথলির পাথর, বাতজ্বর সহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। ষাট ও সত্তর দশকের এই খল-অভিনেত্রীর অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। ১৯৫৮ সালে এ জে কারদার পরিচালিত ‘দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রানী সরকারের অভিষেক হয়। ১৯৬২ সালে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার এহতেশামুর রহমান পরিচালিত উর্দু চলচ্চিত্র ‘চান্দা’তে তিনি অভিনয় করেন। ২০১৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন এই অভিনেত্রী।

চলচ্চিত্র অঙ্গনের এই গুণী মানুষগুলোকে স্মরণ করে আগামী ১৫ জুলাই বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির উদ্যোগে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। গুণী এই চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে রাইজিংবিডি। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ জুলাই ২০১৯/রাহাত/ফিরোজ