বিনোদন

‘বন্ধুত্ব সব সম্পর্কের ঊর্ধ্বের একটি ব্যাপার’

স্কুলজীবনটা অনেক দীর্ঘ। আর এ সময়টাতে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। আবার কৈশোরে একটা বন্ধুত্ব হয়। যখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পা রাখেন তখনো বন্ধুত্ব হয়। তাছাড়া ক্যারিয়ার গড়ার সময়ও বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। আইয়ুব বাচ্চু আমার শৈশবের বন্ধু, যা পেশাদার জীবনেও ছিল। এজন্য তার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। সেসবের অনেক স্মৃতি প্রকাশ করাও হয়নি। আমি জানি, এই সম্পর্কের গভীরতা, অস্তিত্ব কতটুকু।

বন্ধুত্ব এমন একটি বিষয়, যা সব সম্পর্কের উর্ধ্বের একটি ব্যাপার। যেখানে কোনো চাওয়া-পাওয়া, দেনা-পাওনার হিসাব থাকে না। যেখানে শুধু সুখ-দুঃখ, শেয়ারিংয়ের জায়গা থাকে। এই স্পেস দেওয়ার মানুষটাই কিন্তু বড় বন্ধু। এক জীবনে তো অনেক কিছুই হয়। উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখ, নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে পথ হাঁটতে গিয়ে মানুষ যখন অসহায়ত্ব বোধ করে তখন কিন্তু বন্ধুর সাহচর্যের দরকার হয়। জীবনের বিশেষ কোনো দিনে বন্ধুর শারীরিক উপস্থিতি না হোক কিন্তু মানসিকভাবে হলেও তার পাশে থাকা দরকার— এটাই কিন্তু বন্ধুত্ব।

আমার শৈশবের বন্ধু সার্কেল অনেক বড়। হয়তো তারা আমার এই পেশায় নাই। কিন্তু বাচ্চু পরিচিত মুখ। আমার সংগীত ক্যারিয়ার ৩৭ বছরের। এখানে সত্যিকার অর্থে কে আমার বন্ধু সেটা জেনেছি। বন্ধুত্ব ধরে রাখা অনেক কঠিন। কারণ বন্ধুত্ব রাখতে গেলে বন্ধুর প্রতি বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, অঙ্গীকার, প্রত্যাশা অনুযায়ী তার কাছে থাকতে হয় যা অনেক কঠিন।

১৯৭৭ সালে প্রথম যখন ব্যান্ড দল গড়ি তখন বাচ্চুর সঙ্গে আমার অনেক ঘটনা আছে। আমাদের দুই পরিবারের কেউ চাইতো না আমরা গান করি। আমার বাবা একজন ব্যবসায়ী। আমি তার একমাত্র ছেলে। অন্যদিকে বাচ্চু পরিবারের বড় ছেলে ছিল, তাই তার মা-ও চাইতো সে পরিবারের হাল ধরুক, সংগীতের সঙ্গে থেকে উচ্ছন্নে যেন না যায়। ওই সময়ে সংগীতে যাওয়া মানেই উচ্ছন্নে যাওয়া।

এক সময় আমি গিটার বাজাতাম। আমার একটি ডিসকো গিটার ছিল। বাচ্চুও এটা বাজাতো। অধিকাংশ সময় শো করে অনেক রাতে আমরা বাড়ি ফিরতাম। তখন নিউ মার্কেটের একটি বাড়িতে থাকতাম। এটি দোতলা বাড়ি ছিল। বাড়িটির নিচে একটি কাচারি ঘর ছিল। নিরাশ্রয়ী অর্থাৎ যারা ভিক্ষুক ছিল তারা ওই ঘরটিতে রাতে ঘুমাতো। আর আমরা থাকতাম দোতলায়। রাত দেড়টা-দুইটায় যখন বাসায় ফিরতাম তখন ভিক্ষুকদের সঙ্গে ওই কাচারি ঘরে ঘুমাতাম। এমনো হয়েছে যে, শীত লাগছে তখন ভিক্ষুকের কম্বল টেনে গায়ে দিয়েছি। আমার মনে আছে— বাচ্চু, মহম্মদ আলী, রিজভী ও আমি একসঙ্গে ওখানে ঘুমিয়েছি।

একবার মা বুঝতে পারেন, আমরা বাড়ি ফিরেছি। কিন্তু ভয়ে ঘরে ঢুকতেছি না। কারণ বাবা জেনে যাবেন। তখন মা নিচে এসে লাইট জ্বেলে দেখেন— আমি আর বাচ্চু ভিক্ষুকদের সঙ্গে ঘুমাচ্ছি। তারপর আমাদের ডেকে নিয়ে উপরে গেলেন। উপরে উঠে বাতি না জ্বালিয়ে আমরা আস্তে আস্তে রুমে ঢুকে যাই। তারপর মা খাবার দিলেন, খাবার খেয়ে আমার সিঙ্গেল খাটে একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ি।

আমাদের অর্থের চিন্তা-ভাবনা ছিল না। অন্য কোনো পেশায় যাওয়ার চিন্তা ছিল না। কিন্তু কীভাবে আমাদের জীবন চলবে সে চিন্তাও আমাদের ছিল না, চিন্তা একটাই ছিল— আমরা মিউজিক করব। গানকে ভালোবেসে আমরা দুই বন্ধুই বাউলিপনা ধরে ঢাকায় এসেছিলাম। দীর্ঘ যাত্রাপথে আমি আর বাচ্চু একসঙ্গে ছিলাম। কিন্তু সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল। দীর্ঘপথের সহযাত্রী আসলে শুধু বন্ধু থাকে না পরিবার হয়ে যায়। ভাইয়ের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। তখন ওই মানুষটি চলে গেলে, তা মানা যায় না। ভাবা যায়, বাচ্চুকে আর কোনো দিন দেখবো না! আর কোনো দিন তার সঙ্গে কথা হবে না। ইচ্ছে হলেও বাচ্চু কোনোদিন অভিযোগ অনুযোগ করতে পারবে না। বাচ্চুর সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হবে না।

শ্রুতিলিখন: আমিনুল ইসলাম শান্ত।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ আগস্ট ২০১৯/শান্ত/মারুফ