বিনোদন

জীবন সংকেতের ‘বিভাজন’: দৃশ্য-কাব্যেও একটি যথার্থ উদাহরণ

বিগত ১৬ নভেম্বর মধ্যমগ্রাম বাদুতে শ্রদ্ধেয় অগস্ত বোয়াল নামাঙ্কিত প্রেক্ষাগৃহে জন সংস্কৃতির সহযোগিতায় কলকাতার বালার্ক নাট্যদলের আয়োজনে হবিগঞ্জ ‘জীবন সংকেত’ নাট্যগোষ্ঠীর ২৮তম প্রযোজনা ‘বিভাজন’ নাটকটি দেখার সৌভাগ্য হলো। প্রধানত সেই দর্শন প্রতিক্রিয়া হিসেবেই এই লেখার অবতারণা।

দর্শন প্রতিক্রিয়া বলছি, কারণ প্রাজ্ঞ সমালোচকদের শ্যেন দৃষ্টিতে হয়তো এমন কিছু ফাঁক ফোকর ধরা পড়ে, যা সাধারণ দর্শকের চোখে পড়বে না। সাধারণ দর্শক হিসেবে দর্শকাসনে বসে প্রযোজনাটি দেখতে দেখতে যা মন ছুঁয়েছে তাই প্রতিক্রিয়া হিসেবে এখানে উঠে আসবে। মঞ্চ এবং আলোর ব্যবস্থার অপ্রতুলতার জন্য প্রযোজনায় যে অনুল্লেখযোগ্য ফাঁক ফোকরগুলো তৈরী হয়েছে, সেগুলো ভালোতর মঞ্চ পেলে আর থাকে না; এই বিশ্বাসের সাথে আমার প্রতিক্রিয়া আপনাদের সাথে ভাগ করে নেয়া।

নাটকটি লিখেছেন রুমা মোদক। নির্দেশনা দিয়েছেন তিন জন। না একসাথে তিনজন নয়, একে একে তিনজন। প্রযোজনার কাজ শুরু হয়েছিল অনিরুদ্ধ কুমার ধর (শান্তনু)-এর হাত ধরে। পরবর্তীতে সুদীপ চক্রবর্তী তাঁর শিল্পভাবনা যোগ করেন প্রযোজনাটিতে। সর্বশেষ সংযোজন নুসরাত জাহান জিসার ভাবনা এবং শিল্প বোধ। তাই প্রচারপত্রে নাট্যকারের নামের পর তিন জন নির্দেশকের নামই সসম্মানে উপস্থিত। নাটকটির বর্তমান রূপ (তৃতীয় পর্যায়ের নির্মাণ) নুসরাত জাহান জিসা-র নির্দেশিত। নাটকে ব্যবহৃত ‘বড় ভাব লাগাইয়া দিলি মনে রে’ এবং একেবারে শেষে ব্যবহৃত ‘রাখিও যতন করে’ গান দুটো লিখেছেন রুমা মোদক। প্রযোজনায় আবহ পরিকল্পনা করেছেন নুসরাত জাহান জিসা। অনিরুদ্ধ কুমার ধরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে এই প্রযোজনার বর্তমান রূপটি।

‘বিভাজন’ নাম থেকে বিষয় সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায় নিশ্চয়ই, তবু সংক্ষেপে উল্লেখ করার লোভ সামলানো গেল না। বাংলাভাষী বঙ্গবাসী ভাইয়েরা কীভাবে চল্লিশের দশকের শেষের দিকে একে অপরের শত্রু হয়ে উঠল, কীভাবে ভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিন্ন সামাজিক পদমর্যাদার দুই কিশোরের অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব যৌবনে পৌঁছে দুই বিপরীত যুযুধান পক্ষে তাদের দাঁড় করালো, হিংসার কারবারি সিরাজ মিঁয়ারা কীভাবে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই লাগিয়ে দিয়ে মুনাফা লুটল বা ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের হিসেব কষল অথবা প্রতিশোধস্পৃহা পূর্ণ করল, কীভাবে কয়েকটা ভালোবাসার পাখি ডানা ভেঙে নিষ্প্রাণ হয়ে গেল শশীকিশোরদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্বেও; সেই সব এই নাটকে উঠে এসেছে ক্ষয়িষ্ণু জমিদারির ক্যানভাসে একটি কোলাজের রূপ নিয়ে।

   

আলোচনা শুরু করা যাক টেক্সট নিয়েই। নাট্যকার রুমা মোদকের লেখা টেক্সটটি অসাধারণ। নাট্যকার নাটকটিতে দুই রকম প্রকাশভঙ্গি ব্যবহার করেছেন। তিনি বর্ণনাত্মক প্রকাশভঙ্গি এবং সাধারণ দৈনন্দিন প্রকাশভঙ্গি এই দুইয়ের যথাযথ ব্যবহার করেছেন ভাষার দুটি আলাদা রূপের ব্যবহারের মাধ্যমে। চরিত্ররা কথকের মতো গল্প বলতে আসেনি শুধু, আবার তারা শুধু চরিত্র হয়েও আসেনি। অর্থাৎ যে চরিত্ররা মঞ্চে এসেছে, তারা নাটকের গতিবিধি বা নিজের চরিত্রের অবস্থান সম্পর্কে দর্শককে সম্যকভাবে সজাগ করছে এবং নাট্যের এগিয়ে যাওয়াতে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে। তার ফলে নাটকটিতে ভাষার দুটি রূপ স্পষ্ট ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্ণনার অংশগুলোতে ব্যবহৃত ভাষার রূপটি কাব্যিক এবং চরিত্রের সংলাপের ভাষায় কথ্য আঞ্চলিক রূপটি স্পষ্ট। নাট্যশাস্ত্র মতে নাটক হলো দৃশ্যকাব্য। বর্ণনার অংশগুলো প্রকৃত অর্থেই কাব্যের রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই অংশগুলো যেমন হয়েছে হৃদয়স্পর্শী, তেমনি হয়েছে হৃদয়গ্রাহী। নাটকটি তাই শ্রাব্যসুখ দেবে। এই অংশের শব্দ চয়ন এবং বাচনভঙ্গি কথায় প্রাণ সঞ্চার করেছে। তাই নাটক দেখতে গিয়ে সমঝদার দর্শক একই সাথে কাব্য এবং আঞ্চলিক সংলাপের এক অদ্ভুত দাম্পত্য দেখতে পাবেন। এরা একে অপরকে পরিপূর্ণ করছে, কোথাও বিব্রত করছে না।

বিশ শতকের তিরিশ বা চল্লিশের দশকে ক্ষয়িষ্ণু জমিদারীর জমিদাররা (যাদের প্রতিভূ হলেন জমিদার হরপ্রসাদ রায় এবং চরিত্রটিকে সফলভাবেই রূপদান করেছেন অনিরুদ্ধ কুমার ধর) নিজেদের আজন্মলালিত সামাজিক প্রথা, বিশ্বাস, যাপন ছেড়ে বেরুতে পারছেন না। তাই জমিদার হরপ্রসাদ রায় বা আমিনুদ্দির কাছে সমাজে স্থিতাবস্থা থাকা দরকার। আবার সেই জমিদারীর পরবর্তী প্রজন্ম শশীকিশোর আর মনিরুজ্জামান ধর্ম ও সামাজিক অবস্থানের ভেদ মানে না। নতুন যুগের স্বাধীন ভাবনা চিন্তার শরিক হয়েছে। তারা একই সময়ে স্বাধীনতার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে এবং নিজেদের জন্য স্বাধীন দেশের দাবি করে। কিন্তু স্বাধীনতার দাবিতে যখন ভাগ হয় দেশ, তখন কেউই আর বাবাঠাকুরকে ভিটে ছেড়ে যেতে দেবে না।

আবহ এই নাটকটির শ্রাব্য অংশের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাঁশি, সানাই, দোতারা, গিটার, ম্যান্ডোলিন, ঢোল, নাকাড়া, ডাফলি, খমক, শঙ্খ, শিঙ্গা, উকেলেলে এবং হারমোনিয়াম এই নাটকটির আবহ তৈরি করেছে। যারা যন্ত্রগুলো বাজিয়েছেন এবং দৃশ্যকে দিয়েছেন শব্দের মাত্রা তাদের অসামান্য দক্ষতা এবং নির্মাণশৈলী দর্শককে মুগ্ধ করবে নিশ্চিত। অনেক দৃশ্যই জীবন্ত হয়ে উঠেছে আবহ শিল্পীদের দক্ষতায়। বিশেষত মেলার দৃশ্য, বিয়ের দৃশ্য এবং পালা গানের দৃশ্য অনেক বেশি রঙিন এবং বাঙময় হয়ে উঠে যথাযথ আবহের ব্যবহারে। যন্ত্র সঙ্গীতে সুবীর রায়, ফুল মিয়া এবং হরিপদ বাবুর নাম স্বতন্ত্র উল্লেখের দাবি রাখে। প্রচলিত সুরে রুমা মোদকের লেখা ‘বড় ভাব লাগাইয়া দিলি মনে রে’ এবং একেবারে শেষে ব্যবহৃত ‘রাখিও যতন করে’ গান দুটি ভালোলাগার রেশ রেখে যায়।

নাটকের এই ভাষাগত আয়োজন ব্যর্থ হতো যদি অভিনেতারা সাবলীলভাবে বর্ণনা থেকে আলাপে না যেতে না পারতেন। কাজটি আরো কঠিন এই কারণে যে চরিত্রের আবেগ এবং অভিনয়ের অংশগুলির দ্বারা অভিনয়ের অংশ প্রভাবিত হওয়ার এবং একইভাবে বর্ণনা অংশের আপাত নির্লিপ্তি দ্বারা অভিনয়ের অংশ প্রভাবিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অভিনেতারা অনেকাংশেই এই আপাত সহজ কিন্তু বাস্তবে অত্যন্ত কঠিন কাজটি সাফল্যেও সাথেই করতে পেরেছেন। এই নাটকটির সাফল্য কোনো একজন বা দুইজন কেন্দ্রীয় চরিত্রের দুর্দান্ত অভিনয় দক্ষতার উপরে দাঁড়িয়ে নেই। গ্রুপ ওয়ার্ক এই নাটকের অভিনয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে হিন্দু জমিদার হরপ্রসাদ রায়ের ভূমিকায় অনিরুদ্ধ কুমার ধর খুব ভালো। একজন সামন্ততান্ত্রিক জমিদার যার পুত্রসম মনিরুজ্জামানের প্রতি স্নেহ রয়েছে কিন্তু সম্প্রদায় এবং সামাজিক অবস্থান ভুলে যেতেই তাকে অমানুসিক শাস্তি দিতে তার হাত কাপছে না। সে যেমন বংশ গৌরবের কথা কখনও ভোলে না, তেমনি ডাগর মেয়ে মানুষ দেখলেই চোখ চকচক করে, আবার ভিটেমাটির প্রতি তার প্রাণের টান তাই এঁকে সে কিছুতেই ছেড়ে যাবে না। তাই সব মিলিয়ে চরিত্রটি বেশ জটিল। এই অত্যন্ত জটিল চরিত্রটি বেশ উজ্জ্বলভাবেই উপস্থিত থেকেছে সমগ্র প্রযোজনায়।

   

শশীকিশোরের ভূমিকায় শুভ বণিক, আমিনুদ্দির ভূমিকায় আজহারুল ইসলাম মুরাদ, মনিরুজ্জামানের ভূমিকায় মাজহারুল ইসলাম পাভেল এবং সিরাজ মিঁয়ার চরিত্রে ইমতিয়াজ চৌধুরী তুহিন বেশ ভালো। সময় এবং চরিত্রের ছন্দকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে মঞ্চে উপস্থিত করেছেন। আলাদা করে বলতে হবে নারীচরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তাদের কথাও। নুসরাত জাহান জিসা, জিনাত জাহান নিশা ও তন্বী পাল মোট ছয়টি চরিত্রে অভিনয় করেছেন এবং চরিত্রগুলো কোথাও মিশে গিয়েছে বলেও মনে হয়নি। অপেক্ষাকৃত স্বল্প দৈর্ঘেও চরিত্রাভিনেতাদের অভিনয়ও যথাযথ। তবে গ্রুপ ওয়ার্কের অসাধারণ উদাহরণ এই নাটকটি। মেলার অংশে পুতুল নাচের অসাধারণ নির্মাণ দর্শকের চোখে লেগে থাকবে। একইভাবে পালাগান অংশে ‘বড় ভাব লাগাইয়া দিলি মনে রে’ গানটি এবং কল্যাণীর বৈধব্যের দুঃখমেদুর ভাবের প্রতীকস্বরূপ ‘আর একদিন তো পাইলাম না নিরলে’ খুব ভালো নির্বাচন। নাটকের মাঝে বিভিন্ন জায়গায় সাদা বা ছবি আঁকা পর্দা এবং রঙিন কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করে বেশ কিছু সুন্দর দৃশ্যের নির্মাণ করেছে অভিনেতারা। শেষ দিকে লাঠিখেলার কোরিওগ্রাফি নাটকটির দৃশ্য অংশকেও বেশ শক্তিশালী। তাই দৃশ্যকাব্য হিসেবে হবিগঞ্জ জীবন সংকেতের ‘বিভাজন’ সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে বলতেই হবে।

পুনশ্চর মতো করেই রসিক দর্শকের আরও একটু দাবি জুড়ে দিলাম এখানেই। দাঙ্গার অংশ পর্যন্ত যে নাটকটি তরতর করে এগিয়েছে, দাঙ্গার পরেই সেই নাটকটির গতি হঠাৎ করেই অনেকটা কমে যায়। এরপর যে দৃশ্যগুলি রয়েছে তাতে গতিরোধ অসঙ্গতও নয়। তাই শেষের দৃশ্যগুলোসহই নাটকটির শেষের দিকের গতি কোনভাবে একটু বাড়ানো যায় কিনা একটু ভেবে দেখার অনুরোধ রইল অনিরুদ্ধ কুমার ধর-এর কাছে, যার সার্বিক তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে এই প্রযোজনার বর্তমান রূপ।

হবিগঞ্জ জীবন সংকেতের সকল সদস্য-সদস্যা এবং ‘বিভাজন’ প্রযোজনার সকল কুশীলব এবং নেপথ্য শিল্পীদের অন্তরের ভালোবাসা এবং শুভকামান রইলো। হবিগঞ্জ জীবন সংকেত এবং ‘বিভাজন’ এর সাফল্য এবং উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি। কলকাতা/তারা