বিনোদন

এক্সট্রা শিল্পীদের মানবেতর জীবন

দিনাজপুরের মেয়ে স্বপ্না বাবা-মায়ের সঙ্গে ঢাকায় আসেন। স্কুল যাওয়ার সুযোগ হয়নি তার। দিনমজুর বাবার স্বল্প আয়ে তাদের সংসার চলে। এফডিসির কাছে একটি বস্তিতে তাদের বসবাস। বাসা এফডিসির কাছে হওয়ায় শুটিং দেখতে চলে আসতেন স্বপ্না। রুপালি জগতের ঝলমলে আলো দেখে নিজের মনেও বাসনা হয় নায়িকা হওয়ার। এর মধ্যে পরিচয় হয় এক নৃত্য পরিচালকের সঙ্গে। তার নাচের গ্রুপে কাজের সুযোগ পান। এরপর চলচ্চিত্রের পর্দায় কাজের সুযোগ হয়। এরই মধ্যে খ্যাতিমান শিল্পীদের পেছনে নাচারও সুযোগ পেয়েছেন তিনি। কিন্তু নায়িকা হওয়া আর হলো না। বরং চলচ্চিত্রের এক্সট্রা শিল্পী বনে গিয়েছেন। সিনেমায় কাজ করে একদিনে ৫০০-১০০০ টাকা পারিশ্রমিক পান। আবার এই পারিশ্রমিক থেকে একটা অংশ দালালকে দিতে হয়। এদিকে শুটিং যদি আউটডোরে থাকে তখন মাঝে মাঝে বিপাকে পড়তে হয়। অনেক সময়ই মুখোশধারী ভদ্রলোকের লালসা থেকে বাঁচতে নিতে হয় নানা কৌশল। অভাব অনটন আর কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে আপোস করতে হয় স্বপ্নাদের মতো এক্সট্রা শিল্পীদের।

বছরের অধিকাংশ সময়ই এক্সট্রা শিল্পীদের বেকার থাকতে হয়। এখন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে করোনাভাইরাস। করোনার কারণে চলচ্চিত্রের সকল শুটিং বন্ধ। অর্থাভাবে বাসায় দিন কাটছে স্বপ্নার।

এদিকে রাত্রীর সংসারে একটি ছেলে রয়েছে। তাকে নিয়েই তার সংসার। তার স্বামী এখন নামকরা চিত্রনায়ক। কিন্তু রাত্রী ও তার সন্তানকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না তিনি। রাত্রীর স্বামী যখন তারকা হয়ে উঠেনি তখন রাত্রীই ছিলেন তার একমাত্র প্রেমিকা। স্টার থেকে সুপারস্টার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে প্রেমিকা। এদিকে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে একলা চলছেন রাত্রী। অভাব অনটনে দিনাতিপাত করলেও স্বামীর নাম প্রকাশ করে তাকে বিপাকে ফেলতে চাননা।

করোনার মৃত্যু ভয়ের চেয়েও ক্ষুধার ভয় সারাক্ষণ পীড়া দেয় তাকে। এ প্রসঙ্গে রাত্রী বলেন, ‘অসংখ্য চলচ্চিত্রে জুনিয়র শিল্পী হিসেবে কাজ করে ছেলেটাকে বড় করছি। অর্থাভাবে পড়ালেখা করাতে পারছি না। সিনেমার কাজ করে প্রত্যেকদিন ১ হাজার টাকা করে পেতাম। ধীরে ধীরে সিনেমার কাজ কমে যায়। নিজে না খেয়ে ছেলেটাকে খাইয়েছি। এর পর দেখলাম শুধু সিনেমায় কাজ করে পেট বাঁচবে না। তারপর পার্লারে কাজ শুরু করি। কিন্তু করোনার কারণে তাও বন্ধ হয়ে যায়। ঘরে খাবার সীমিত৷ কয়েকদিন গেলেই তা শেষ হয়ে যাবে। কী করব বুঝতেছি না। এদিকে ছেলেটাকে কাজে দিয়েছি সেখান থেকেও টাকা পাইনি।’

মর্জিনা নামে পার্শ্ব বা এক্সট্রা চরিত্রে অভিনয় করা একজনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘কাজের অভাবে উপোস করেছি দিনের পর দিন। অভিনয় করলে ৫০০-১০০০ টাকা পর্যন্ত পেতাম এক সময়। এর মধ্যে একেক শিফটের জন্য দালালের মাধ্যমে কাজ পেলে অর্ধেক দিতে হয় তাদের। এসব দিয়ে আমাদের কাছে আর টাকা তেমন থাকে না। এখন কী করব বুঝতেছি না।’

কাজ না করলে স্বপ্না, মর্জিনার মতো আরো কয়েক শ’ এক্সট্রা শিল্পীকে না খেয়ে থাকতে হবে। চলচ্চিত্রের মন্দা আর করোনার কারণে শুটিং বন্ধ হওয়ায় এক্সট্রা শিল্পীদের দুর্দিন এখন চরমে! 

এক্সট্রা শিল্পীদের নিয়ে ‘জুনিয়র আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি সংগঠনও ছিল। সাড়ে ৩০০ সদস্যকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সংগঠনটি। জুনিয়র শিল্পীরা কেউ কেউ এখন শিল্পী সমিতির অন্তর্ভুক্ত। তাদের নিজস্ব সংগঠন না থাকায় কোনোরকম সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা।  অনেকেই মনে করছেন এভাবে চলতে থাকলে দেহব্যবসার মতো অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন এসব শিল্পীরা।

এক্সট্রা শিল্পী বা জুনিয়র শিল্পীদের ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। চলচ্চিত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তারা। তাছাড়া এক্সট্রা শিল্পী থেকে কিংবদন্তি হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। এ তালিকায় রয়েছেন—জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানা। তবে তিনি অভাবের তাড়নায় নয়, চলচ্চিত্রকে ভালোবেসেই এক্সট্রা হিসেবে এ অঙ্গনে আসেন। পরে তিনি কিংবদন্তি অভিনেত্রী হয়েছেন। নায়করাজ রাজ্জাকও প্রথমে ‘১৩ নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন’ সহ কয়েকটি সিনেমায় এক্সট্রা শিল্পী হিসেবেই অভিনয় করেন। পরবর্তীতে অনেকের মধ্যে এক্সট্রা থেকে নায়ক-নায়িকা হয়েছেন আলেকজান্ডার বো, শাহীন, দিলদার, সাহারা, ময়ূরী, শানু, সূচনা, নদী, ঝুমকা, জিনিয়া, নাসরিন, সোনিয়া প্রমুখ।

 

ঢাকা/রাহাত সাইফুল/শান্ত