বিনোদন

শুভ জন্মদিন কিংবদন্তি

বাংলার কিংবদন্তি সেতারসাধক পণ্ডিত রবিশঙ্কর। বিশ্ববরেণ্য এই শিল্পীর আজ জন্মশতবর্ষ। ১৯২০ সালে ৭ এপ্রিল ভারতের বেনারসে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে উঠেছেন সেখানে। তবে তাঁর আদি নিবাস বাংলাদেশের নড়াইল।

রবিশঙ্করের পুরো নাম রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরী। পরিবারের মানুষ তাঁকে ‘রবু’ ডাকতেন। চার ভাইয়ের মধ্যে রবিশঙ্কর ছিলেন ছোট। বাবা শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী ছিলেন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক এবং আইনজ্ঞ। কিন্তু দুঃখের কথা হলো—বাবার অবর্তমানে বেড়ে উঠেছেন রবিশঙ্কর। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে মা হেমাঙ্গিনী তাকে বড় করেন।

রশিঙ্করের বড়দা উদয় শঙ্কর ছিলেন প্রখ্যাত ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী। তখন তিনি বাস করতেন প্যারিসে। ১৯৩০ সালে মায়ের সঙ্গে প্যারিসে বড়দার কাছে চলে যান রবিশঙ্কর। সেখানে আট বছর স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। মাত্র বারো বছর বয়স থেকেই রবিশঙ্কর বড়দার নাচের দলের একক নৃত্যশিল্পী ও সেতার বাদক। কিশোর বয়েসেই ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠান করেছেন তিনি।

১৯৩৮ সাল। তখন রবিশঙ্করের বয়স ১৮। তিনি উদয় শঙ্করের নাচের দল ছেড়ে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী আচার্য আলাউদ্দীন খাঁর কাছে সেতারে দীক্ষা নিতে শুরু করেন। এ সময় আলাউদ্দীন খাঁর পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর সংস্পর্শে আসেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন স্থানে দুজন সেতার-সরোদের যুগলবন্দি বাজিয়েছেন। আলাউদ্দীন খাঁর কাছে রবিশঙ্কর দীর্ঘ সাত বছর শিক্ষা গ্রহণ করেন।

১৯৩৯ সালে ভারতের আহমেদাবাদে রবিশঙ্কর প্রথম উন্মুক্ত মঞ্চে একক সেতার পরিবেশন করেন। সেই তার শুরু। এরপর নিজেকে তুলে ধরেছেন একজন বৈশ্বিক সংগীতজ্ঞ, সংগীত স্রষ্টা ও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের মেধাবী দূত হিসেবে। ১৯৪৫ সালের মধ্যে রবিশঙ্কর সেতার বাদক হিসেবে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পান। ৬০ বছর ধরে সংগীতসাধনা করে গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছেন তিনি।

১৯৪৯ সালে রবিশঙ্কর দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া রেডিওর সংগীত পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। একই সময়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বৈদ্য বৃন্দ চেম্বার অর্কেস্ট্রা। ১৯৫০-১৯৫৫ সাল পর্যন্ত রবিশঙ্কর অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সংগীত সৃষ্টিতে নিমগ্ন ছিলেন। এ সময়ে তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হলো—সত্যজিৎ রায়ের অপু ত্রয়ী (পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও অপুর সংসার)। পরবর্তীতে চাপাকোয়া (১৯৬৬), চার্লি (১৯৬৮) ও গান্ধী (১৯৮২) সহ আরো বেশ কিছু চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন।

২১ বছর বয়সে রবিশঙ্কর বিয়ে করেন গুরু আলাউদ্দিন খাঁর মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবীকে। তাঁদের ছেলের নাম শুভেন্দ্রশঙ্কর। পরে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। এরপর মার্কিন কনসার্টের উদ্যোক্তা স্যু জোন্সের সঙ্গে সম্পর্ক হয় তাঁর। তাঁদের সন্তান নোরা জোন্স সুনাম কুড়িয়েছেন জ্যাজ, পপ, আধ্যাত্মিক ও পাশ্চাত্য লোকসংগীতের শিল্পী ও সুরকার হিসেবে। নোরা ২০০৩ ও ২০০৫ সালে ১০টি শাখায় গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন। রবিশঙ্কর পরে ভক্ত সুকন্যা কৈতানকে বিয়ে করেন। তাঁদের মেয়ে আনুশকা শঙ্কর সেতারশিল্পী হিসেবে বিখ্যাত। রবিশঙ্করের সৃষ্টি যেমন বিপুল, তাঁর অর্জনও তেমনি অপরিমেয়। ভারতীয় সংগীতের অন্যতম প্রধান পুরুষ তিনি। সংগীতের জন্য গ্র্যামি, ভারতরত্ন—সবই পেয়েছেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় রবিশঙ্করের ভূমিকা আমাদের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার কথা জেনে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। এই সময় তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলায় দুটি গান লিখে রেকর্ড করেছেন। সে সময় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য একটি কনসার্ট করার কথাও তাঁর মনে হয়। এ ব্যাপারে তিনি জর্জ হ্যারিসনের সাহায্য চান। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট মেডিসন স্কয়ারে অনুষ্ঠিত এই কনসার্ট শুরু হয়েছিল আলী আকবর ও রবিশঙ্করের সরোদ ও সেতারবাদন দিয়ে। ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এই কিংবদন্তি।

ঢাকা/শান্ত/তারা