বিনোদন

ওয়েব সিরিজে ‘আপত্তিকর’ দৃশ্য: কী ভাবছেন সহশিল্পীরা?

গত ঈদুল ফিতরে অনলাইনে মুক্তি পেয়েছে ওয়েব সিরিজ ‘বুমেরাং’। আদনান ফারুক হিল্লোল ও নাজিয়া হক অর্ষা অভিনীত ওয়েব সিরিজটি নির্মাণ করেছেন ওয়াহিদ তারেক।

অন্যদিকে সত্য ঘটনা অবলম্বনে শিহাব শাহীন নির্মাণ করেছেন ক্রাইম থ্রিলার ওয়েব সিরিজ ‘আগস্ট ১৪’। ঐশী নামের বখে যাওয়া পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ের গল্প নির্মিত হয়েছে এটি। এতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাসনুভা তিশা।

এসব ওয়েব সিরিজে খোলামেলা দৃশ্যে হাজির হয়েছেন শিল্পীরা। এ নিয়ে নেটদুনিয়ায় চলছে নানা বিতর্ক। প্রধান দুই নারী শিল্পীকে ফেসবুকে নানাভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন—যৌনতা ও সহিংস দৃশ্য সেখানে ডালভাতের মতোই দেখানো হয়েছে। এদিকে সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবী রোববার (১৪ জুন) অনলাইন থেকে ‘আপত্তিকর’ এসব দৃশ্য সরিয়ে নেওয়ার জন্য আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন। কিন্তু পরিচালকের দাবি—এসবই করেছেন গল্পের প্রয়োজনে। এ পরিস্থিতিতে ইন্ডাস্ট্রির অন্য অভিনয়শিল্পীরা কী ভাবছেন? বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বেশ কজন অভিনেত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে রাইজিংবিডির সঙ্গে আলাপকালে নিজেদের মতামত দিয়েছেন অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধন ও জ্যোতিকা জ্যোতি।

বাঁধন বলেন, ‘আমি একজন অভিনেত্রীকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা রাখি বলে মনে হয় না। আমার মতামত অন্যদের সঙ্গে নাও মিলতে পারে। তারপর বলছি, অর্ষা অনেক ভালো অভিনেত্রী এ কথা সবাই জানি। অভিনেত্রী হিসেবে কেমন তা কিন্তু সে এরই মধ্যে প্রমাণ করেছে। অভিনেত্রী কেমন অভিনয় করবেন সেটা বেশিরভাগই নির্ভর করে পরিচালকের উপর। অর্ষা যে পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন, সে খুবই ভালো একজন নির্মাতা। অর্ষা, পরিচালকের কাজ ও শিল্পটাকে নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।’

‘আগস্ট ১৪’ ওয়েব সিরিজে তাসনুভা তিশার অভিনয়ের প্রশংসা করে বাঁধন বলেন, ‘তিশার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছি। একজন অভিনয়শিল্পীর ভেতরের অভিনয়টা বের করার জন্য একজন ভালো পরিচালক জরুরি। নতুন যারা কাজ করছেন তাদেরকে এই কাজটি আশার আলো দিয়েছে। অনেক পরিচালকই প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীদের নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেন। একজন অভিনয়শিল্পী অভিনয়টা করেন পরিচালকের নির্দেশনা অনুযায়ী। আমার মনে হয়েছে, এই কাজটি দিয়ে তিশা সেই জায়গাটি প্রমাণ করেছে। সহশিল্পী হিসেবে বলছি, অর্ষা ও তিশা খুব ভালো করেছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।’

অনেকে বলছেন এই ধরনের ওয়েব সিরিজ পরিবার বা বাচ্চাদের নিয়ে দেখা যায় না। কিংবা এগুলো বাচ্চারা দেখে ফেলছেন। তাদের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে এ অভিনেত্রী বলেন, ‘এই ওয়েব সিরিজের প্রভাব নিয়ে যারা বেশি চিন্তা করছেন তাদেরকে বলছি, ওয়েব সিরিজে লেখা ছিল এটা ১৮ প্লাস কনটেন্ট। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনার বাচ্চার হাতে মোবাইল দিয়ে রাখছেন কেন? এটা কিন্তু আমাদের অপরাধ! আমার বাচ্চা কোন বয়সে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করবে এবং তা কীভাবে করবে সেটা আমাকেই নির্ধারণ করতে হবে। পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও স্বশিক্ষার সংমিশ্রণে একজন মানুষ পরিণত হন। ১৮ বছরের পূর্ব পর্যন্ত সন্তানের এসব দায়িত্ব বাবা-মায়ের। তারপর একটি ছেলে-মেয়ে নিজের মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা পায়। তার মানে এই নয় ছেলে-মেয়েরা তখন যা খুশি তাই করবে। বলতে চাচ্ছি, এই বয়সের আগ পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদের সেই শিক্ষাটা দিতে হবে, যা থেকে তারা শিখতে পারে কী গ্রহণ করবে আর কী বর্জন করবে।’

ওয়েব সিরিজের বিষয়টি নিয়ে সবাই যেভাবে প্রতিবাদ করছেন, সেখানকার একভাগ মানুষও যদি সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হওয়া একজন মেয়ের জন্য হতো তবে সমাজ এমন থাকতো না। একটি দুই বছরের শিশু ধর্ষিত হয়, ধর্ষণের কারণ হিসেবে মেয়েদের পোশাককে দায়ী করা হয়। অথচ বাচ্চাদের ইন্টারনেট ব্যবহার, সেক্স এডুকেশন, বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যার বিষয়ে বাচ্চাদের শিক্ষা দেওয়া হয় না। সমাজের এক ভাগ মানুষও যদি এসব বিষয়ে চিন্তা করতো তবে সমাজটা আরো অনেক দূর চলে যেত বলে মনে করছেন এই অভিনেত্রী।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেয়প্রতিপন্নের শিকার হয়েছেন অর্ষা-তিশা। বিষয়টি স্মরণ করে বাঁধন বলেন, ‘অর্ষা-তিশাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে হেয়পতিপন্ন করা হয়েছে সেটা খুবই দুঃখজনক। এজন্য ওদেরই তাদের বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ পাঠানো উচিত ছিল। এভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার অধিকার কারো নেই। আমাদের সমাজে মেয়েরা তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনা সহ্য করে বলেই মানুষ আরো করতে পারে।’

‘একটি মেয়ে যখন ধর্ষিত হয়, রাস্তায়-অফিসে নিগ্রহের শিকার হয়, বাড়িতে নির্যাতিত হয় তখন কি প্রতিবাদ করে রাস্তায় নেমেছিলেন? প্রতিবাদ করে মেয়েটির পাশে কেউ কি দাঁড়িয়েছেন? সমাজের এসব বিষয় নিয়ে না ভেবে নাটক, সিনেমা, ওয়েব সিরিজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন! তাও আবার এই করোনা সংকটকালে! আসলে আমাদের সমস্যাটা শিক্ষা, চিন্তা-চেতনা ও মননে।’ বলেন বাঁধন।

অন্যদিকে অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি তার বক্তব্যের শুরুতে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, চরিত্রের প্রয়োজনে কোনো শিল্পীর যদি ন্যুড শট দিতে হয় তবে সে দিবে। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ভিউ বাড়ানো বা আধুনিকতা বুঝানোর জন্য আরোপিত যৌন দৃশ্য ব্যবহার করাটা আত্মঘাতী। আমি এটার পক্ষে না। যে ওয়েব সিরিজগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেগুলোর পরিচালকরা খুবই ভালো কাজ করেন। বিশেষ করে বুমেরাং এর পরিচালক ওয়াহিদ তারেক আমার খুবই পছন্দের পরিচালক এবং ভালো মানের কাজ করে থাকেন। তবে এই সিরিজটি দেখে প্রথমে ধাক্কা খেয়েছি।’

একজন শিল্পী হিসেবে ন্যুড শট দিতে জ্যোতিকা জ্যোতিরও আপত্তি নেই। বিষয়টি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার কথা হচ্ছে চরিত্রের প্রয়োজনে ন্যুড শট দিতে আমারও আপত্তি নেই। কিন্তু এই ওয়েব সিরিজের গল্প এসব দৃশ্য আমার কাছে মানানসই মনে হয়নি। এমনটা কেন মনে হয়েছে জানি না। সেটা প্রেজেন্টেশন বা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে। কিন্তু শঙ্কার বিষয় হলো—এরপর এ ধরণের কাজ অন্য কেউ করবেন, যাকে কেউ চেনে না, কাজ বুঝে না, তখন এতটাই খারাপ হবে যে খুব নোংরা পর্যায়ে চলে যেতে পারে। যেমনটা হয়েছে আমাদের মিউজিক ভিডিওর ক্ষেত্রে। তারপরও নির্মাতা যেটা বলার চেষ্টা করেছেন আমার মনে হয় সেটা ভেবেই বলেছেন।’

অনেকে বলছেন, এ ধরনের কাজ পরিবারের সঙ্গে দেখা যায় না। তাদের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে জ্যোতি বলেন, ‘সবকিছু কেন পরিবারের সঙ্গেই দেখতে হবে? ওয়েব সিরিজ বিশ্বব্যাপী কম্পিটিশন করছে। এক্ষেত্রে এমনটা হতেই পারে। কিন্তু গল্পটা তো আমাদের দেশের। এমন তো নয় যে এ গল্প আমাদের নয়। গল্পের সঙ্গে সমাজের মিল না থাকলে এভাবে দেখিয়েতো লাভ নেই। আর এজন্য হয়তো বিব্রতকর লেগেছে। শুধু দেখানোর জন্য দেখানোটা ঠিক মনে হয়নি।’

‘আপত্তিকর’ দৃশ্য সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আইনজীবীর পাঠানো নোটিশ প্রসঙ্গে জ্যোতি বলেন, ‘যারা এই ওয়েব সিরিজ বানিয়েছেন তারা প্রত্যেকে অনেক ভালো মেকার। কিন্তু  এটা ফলো করে যখন নিম্ন মানের রুচির লোকেরা ওয়েব সিরিজ নির্মাণ শুরু করে তখন সেগুলোতে না থাকবে গল্প না থাকবে মেকিং। শুধু শরীর দেখানোই হবে। এতে করে বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজের প্রতি মানুষের বাজে একটা ধারণা তৈরি হবে এবং কেউ দেখবে না। সে জায়গা থেকে অনলাইনে যদি এই দৃশ্যগুলো না থাকে তবে আমার মনে হয় ভালোই হবে। যে বিষয় সোসাইটি বিলং করে না সেটা দেখানো কতটা যৌক্তিক তা আমি জানি না। আসলে কাউকে একা দোষারোপ করে তো লাভ নেই, পরিচালক, প্রযোজক, ওয়েব প্লাটফর্ম ওনার, বিজ্ঞাপনদাতা, আর্টিস্ট, দায়িত্ববোধটা সবারই থাকা উচিত।’

 

ঢাকা/শান্ত