বিনোদন

‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ নিয়ে স্টান্টবাজি করিনি: উজ্জ্বল

ছোট পর্দার গুণী নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’। এর কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন—শার্লিন ফারজানা ও ইমতিয়াজ বর্ষণ। আগামী ২৩ অক্টোবর বড় পর্দায় মুক্তি পাচ্ছে সিনেমাটি। এর ট্রেইলার, গান প্রকাশের পর পরই আলোচনায় উঠে আসে সিনেমাটি। মুক্তি উপলক্ষে সিনেমাটির নানা বিষয় নিয়ে পরিচালক মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের সঙ্গে কথা বলেছেন রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক আমিনুল ইসলাম শান্ত।

রাইজিংবিডি: এ সময়ে অনেকেই সিনেমা মুক্তি দিতে এগিয়ে আসেননি। কিন্তু ঝুঁকি নিয়ে আপনি কেন সিনেমাটি মুক্তি দিচ্ছেন?

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল: মাস খানেক আগে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের চলচ্চিত্রের নেতারা বৈঠক করেন। তখন ফেসবুকে ঘোষণা দিয়েছিলাম—করোনা সংকট কাটিয়ে দেশের সিনেমা হল খোলার পর আমি বিশেষ ভূমিকা রাখতে চাই। যাতে সিনেমা হল সিনেমার সংকটে না ভোগে। জানি, বর্তমান পরিস্থিতিতে সিনেমা মুক্তি দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এই সংকটে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পাশে দাঁড়াতে চাই।

রাইজিংবিডি: সিনেমাটি শুধু মাল্টিপ্লেক্সে মুক্তি পাচ্ছে—

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল: আপাতত সিনেমাটি শুধু মাল্টিপ্লেক্সে মুক্তি দিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছি। এক. শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মানছে কোন কোন সিনেমা হল, তা নিশ্চিত করতে আমাদের প্রতিনিধি হল পরিদর্শন করবে। কারণ চাই না, আমার সিনেমা দেখতে এসে কেউ করোনায় আক্রান্ত হোক। যেসব হলমালিকরা ভালোভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি। দুই. আমাদের সিনেমা ডিস্ট্রিবিউশনের বিষয়টি কখনো সিস্টেমেটিক ছিল না। দীর্ঘ লকডাউনের কারণে তা আরো ভেঙে গেছে। ভেঙে পড়া সিস্টেমের মধ্যে বিগ রিলিজের সিদ্ধান্ত কিন্তু কোনো বুদ্ধিমানের কাজ না। এটা কিন্তু আমার অপারগতা না, কিংবা হল পাচ্ছি না বিষয়টি তা-ও নয়। আবার বিগ রিলিজ দিচ্ছি না—এটাকে বুদ্ধিমত্তা বললে বুদ্ধিমত্তা! ভেঙে পড়া সিস্টেমের মধ্যে তো আপনি বিগ রিলিজ দেবেন না। মানুষের মানসিক অবস্থাটা আগে বিচার করব, স্বাস্থ্যবিধি কতটা মানা হচ্ছে তা দেখব। যারা স্বাস্থবিধি মেনে হল চালাচ্ছেন তাদের সঙ্গে আমরা কাজ করব। স্বাস্থ্যঝুঁকি নিতে পারব না, এটাই হচ্ছে বড় কথা।

রাইজিংবিডি: দর্শক আপনার টিভি নাটক দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি অনেকে বলেন—‘আপনি হাই থটের কাজ করেন’। এক্ষেত্রে আপনি কী বিশেষ শ্রেণির দর্শকদের জন্য সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন?

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল: অনেকে আমাকে শ্রেণিকরণ করেন যে, আমি শিক্ষিত মানুষের পরিচালক। আসলে এটা খুব বাজে একটি শ্রেণিকরণ। কারণ আমি শৈশবে কৃষকের বাড়িতে মান্না দের গান বাজতে শুনেছি। তারমানে মানুষ সবসময় ভালো জিনিসটাকে গ্রহণ করেন। কিন্তু ভালো জিনিসটা মানুষের দুয়ারে পৌঁছাতে হবে। কারণ সেতো উদ্যোক্তা না, সে ভোক্তা। একজন ভোক্তা দায়িত্ব নেন না, দায়িত্বটা উদ্যোক্তাকে নিতে হয়। কী বানাবে সে দায়িত্ব উদ্যোক্তার। আসলে ‘হাই থট’ বলে কিছু নেই। আমার চিন্তাটা ভূঁইফোড় কোনো চিন্তা না। ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন—‘ভাবো, ভাবার প্র্যাকটিস করো।’ আমার চিন্তাটা ভাবার প্র্যাকটিস করতে করতে তৈরি হয়েছে। প্র্যাকটিস করতে করতে তৈরি হওয়া জিনিসে দায়বদ্ধতা, দায়িত্বশীলতা থাকে। আমার চিন্তাটি কোনো ‘হাই থট’ নয়, সচেতন চিন্তা। সিনেমা ব্যাপারটি হলো মানুষের সঙ্গে আপনি কমিউনিকেশন করতে পেরেছেন কিনা! এক্ষেত্রে আমার একটি পরিকল্পনা রয়েছে, যা আমি বাস্তবায়ন করতে চাই।

রাইজিংবিডি: আপনার পরিকল্পনাটি কী?

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল: রিকশাওয়ালা বা মজুর শ্রেণি, যাদের বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখার সামর্থ্য নাই। আমি এদের নিয়ে একটি প্রিমিয়ার করতে চাই। আমি তাদেরকে নিজ উদ্যোগে সিনেমাটি দেখাতে চাই। যাদের সামর্থ্য আছে তাদেরকে ফ্রি টিকিটের ব্যবস্থা করা কিংবা ফ্রি সিনেমা দেখানোটা আমার কাছে আজব লাগে! হ্যাঁ, যারা ক্রিটিক্স তাদেরও টিকিট কেটে সিনেমা দেখার অনুশীলন করার একটা দায় রয়েছে। আমি প্রিমিয়ার করব সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে। সিনেমাটি দেখিয়ে আমি তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইব। কারণ আমি তাদের জন্যও সিনেমাটি বানিয়েছি। আমি আপামর জনতার জন্য সিনেমাটি বানিয়েছি। আমি শ্রেণিকরণের কোনো নির্মাতা নই। বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা করা লোকজন এই শ্রেণিকরণ করে থাকেন। একটি উদাহরণ দিই—টাইটানিক একটি ইংরেজি ভাষার সিনেমা। সাবটাইটেল ছাড়াও এই সিনেমা বাংলাদেশের বস্তিতে বস্তিতে হিট সিনেমা ছিল। কারণ টাইটানিক ভিজ্যুয়ালি মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পেরেছিল।

সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হয়ে থাকে, এই নির্মাতা শিক্ষিত শ্রেণির নির্মাতা। এসব একদম ভুয়া কথাবার্তা। কেউ যদি নির্মাতা হয়ে থাকেন, তবে সবাই তাকে গ্রহণ করবেন। হ্যাঁ, আপনি যদি আপামর জনগণকে ক্রমাগত অখ্যাদ্য দিতে দিতে পেটে আলসার বানিয়ে ফেলেন তবে তো তিনি খাবার গ্রহণ করতে পারবেন না! আসলে আপনি কি সরবরাহ করছেন তার উপর নির্ভর করে আপনার কোন ধরনের দর্শক তৈরি হবে।

রাইজিংবিডি: সিনেমা মুক্তির আগে প্রচারের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানা ধরনের পলিসি গ্রহণ করে থাকে। অনেক সময় স্টান্টবাজিও করে থাকে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে এমনটা দেখা যায় না কেন?

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল: শুরুতে বলে রাখি, এটি আমাদের দেশে অনেক বড় ঘাটতি সেটা বলব না। বিষয়টি আমি একটু অন্যভাবে বলতে চাই। মুম্বাইতে সিনেমার প্রচারের জন্য স্টান্টবাজি করে। খেয়াল করে দেখবেন, ওদের সিনেমা অদ্ভুত। ক্ষেত্র বিশেষে উদ্ভট জায়গা থেকে সিনেমা নির্মিত হয়ে থাকে। জহির রায়হান, খাঁন আতাউর রহমান, নারায়ণ ঘোষ মিতার মতো নির্মাতাদের চলচ্চিত্র যদি খেয়াল করেন তবে দেখবেন—আমাদের ন্যারেটিভ কিন্তু অনেক জীবনঘেষা। সুতরাং আমাদের স্টান্টবাজির দরকার নেই। আমিও ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ সিনেমার প্রচার করছি। কিন্তু সেটা আমার কনটেন্টকে ঘিরে করছি। কনটেন্টের বাইরে গিয়ে স্টান্টবাজি নয়। কারণ কনটেন্ট যদি শক্তিশালী না হয় তবে সেই কনটেন্ট হলে গিয়ে দেখে মানুষ হতাশ হবেই। নিকট অতীতে আমাদের কিছু সিনেমার ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা গিয়েছে। স্টান্টবাজির কারণে মানুষ সিনেমা দেখতে গিয়ে হতাশ হয়েছে। পরিণাম দর্শকের গালি। আমি এটা চাই না। আমি চাই, আমার সিনেমার কারণে মানুষ হলে আসুক। আমি আমার সিনেমার প্রচার গুছিয়ে করার চেষ্টা করছি। বাকিদেরও গুছিয়ে করার আহ্বান জানাই। আমি বুদ্ধিভিত্তিক ক্যাম্পেইনের পক্ষে।

রাইজিংবিডি: আমাদের দেশে বুদ্ধিভিত্তিক ক্যাম্পেইনেরও অনেক ঘাটতে আছে…

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল: হ্যাঁ, এখানে আমাদের দেশ পিছিয়ে আছে সেটা আমি মানি। এখানে আমাদের চেষ্টা করতে হবে। আমার সিনেমার প্রচারের জন্য ভালো কিছু চিন্তা ব্যবহার করে ক্যাম্পেইনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু করোনা সংকটের কারণে তা পারিনি। আর হাতে যা সময় আছে তাতে ওই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

রাইজিংবিডি: সিনেমাটির গল্পের বিষয়ে জানতে চাই।

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল: সম্পর্ক, বিশ্বাস আর আস্থার গল্প ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’।

রাইজিংবিডি: আপামর জনতার জন্য সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন। এই মুহূর্তে সিনেমাটি দর্শক কেন দেখবেন?

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল: প্রথমত মানুষজন সিনেমা দেখতে চান। গত ৮ মাস সিনেমা হল বন্ধ ছিল। সবাই বন্দি জীবনযাপন করেছেন, তাই একটু দম নেওয়ারও ব্যাপার আছে। দ্বিতীয়ত, আমি কনটেন্ট কেন্দ্রীক ক্যাম্পেইন করেছি। যার কারণে মানুষজন কনটেন্ট দেখেই আগ্রহী হয়েছেন, কোনোরকম স্টান্টবাজি দেখে আগ্রহী হননি। এরই মধ্যে দর্শকরা বলে দিয়েছেন কেন তারা সিনেমাটি দেখতে হলে যাবেন। আশা করছি, যে প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ হলে যাবেন তা পূরণ হবে। কারণ সম্পূর্ণ নতুন কিছু দেখতে পাবেন তারা।

রাইজিংবিডি: সিনেমাটির নায়ক-নায়িকা নতুন মুখ। এক্ষেত্রে একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। দর্শক তাদের কতটা গ্রহণ করবেন বলে মনে করছেন?

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল: আমি অত্যন্ত আশাবাদী। সুপারস্টারদের নিয়ে কাজ করার সুযোগ ছিল। নতুন মুখ নেওয়ার কারণ হচ্ছে—একটি চরিত্র অভিনেতা-অভিনেত্রীর ভেতরে ধারণ করার জন্য সময় দিতে হয়। সুপারস্টাররা অধিক মাত্রায় ব্যস্ত থাকেন। তাদের ব্যস্ত থাকাটা যুক্তিযুক্ত। স্বাভাবিক কারণে গল্পের চরিত্রটি গড়ে তোলা অনেক কষ্টকর। তারা হয়তো শুটিংয়ের এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ আগে রিহার্সেল করতে পারতেন। কিন্তু ওইটুকু সময় আমার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। নির্মাণ শব্দটাই হচ্ছে আস্তে আস্তে তৈরি করা! দীর্ঘ সাত মাস নতুন মুখদের তৈরি করেছি। তার আউটপুট পর্দায় দেখা যাবে। পরিচালক হিসেবে তাদের অভিনয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। আর এজন্য ভয় পাচ্ছি না। নতুনদের জেনেশুনেই নিয়েছি।

রাইজিংবিডি: সমকালীন যেসব চলচ্চিত্র দেশে নির্মিত হচ্ছে, সেসব থেকে আপনার সিনেমাটি কোথায় আলাদা?

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল: আমার সিনেমাটি কোনো ধারায় ফেলতে পারবেন না। নির্দিষ্ট কোনো ঘরানায় যখন ফেলতে পারবেন না, তখন অন্যদের থেকে এটি আলাদা!

রাইজিংবিডি: গল্প, চিত্রনাট্য, সংগীত, শিল্পনির্দেশনা, পরিচালনা—সব আপনি নিজে করেছেন। এই সিদ্ধান্ত কেন নিলেন?

মাসুদ হাসান উজ্জ্বল: এই ক্ষেত্রে মানুষটিকে বলা হয়— jack of all trades master of none. আমি আমার গোটা জীবন এসব প্রশিক্ষণের পেছনে ব্যয় করেছি। প্রত্যেকটি বিষয়ের প্রশিক্ষণের পেছনে দীর্ঘ সময়ের ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে। আমাকে যদি এসব ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা করে চাকরি করতে বলেন তবে প্রতিটির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছি। সুতরাং এই যোগ্যতা আমার গভীরভাবে রয়েছে। যার কারণে এই কাজগুলো নিজেই করেছি। আমি পেইন্টিংয়ের ছাত্র। এক ক্যানভাসে দুই তিনজন মিলে ছবি আঁকে না। সিনেমা একটি টিমওয়ার্ক। টিমওয়ার্কের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। চিত্রনাট্য, শিল্পনির্দেশনা, সংগীত—এগুলো সিনেমার হৃদপিণ্ড। এসব ছাড়া সিনেমা হয় না। আমি চেয়েছি এসব বিষয় আমার হাতেই থাকুক। সিনেমার জন্য শৈশব থেকে প্রস্তুত হয়েছি। সুতরাং এই প্রস্তুতির আউটপুট তো আমি চাইব-ই! স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে নিজেকে তৈরি করেছি।