বিনোদন

টেলিভিশনের অসুখ এবং একাল সেকাল

আর একটা বছর পার হলে টেলিভিশনে আমার মুখ দেখানোর ২৫ বছর পূর্ণ হবে। এই লাইনটি পড়ার সাথে সাথে অনেকেই আমার বয়স বা শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু কথা বলতে পারেন। যেমন অনেকেই আমাকে ইদানীং প্রায়ই বলে থাকেন, আমার শরীরটা একটু ভারী হয়ে গেছে, মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে, দেখতে আগের মতো নেই। মোট কথা আমার ভেতর সেই কচি(!) ভাবটা নেই। এটাই বাস্তবতা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক।

অনেকে আবার হলিউড-বলিউডের অনেক অভিনেতাদের সাথেও তুলনা করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। তারা যদি দীর্ঘ বয়স পর্যন্ত নিজেদেরকে সুন্দর ও সুঠামদেহী রাখতে পারেন, আমি বা আমরা কেন পারছি না? এই দীর্ঘ লেখা পুরোটা পড়লে অনেক প্রশ্নেরই জবাব মিলতে পারে। বোঝা যাবে আমরা কোথায়, কীভাবে কাজ করছি।

তবে এই লেখাটি আমার টেলিভিশন/ সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোকে উদ্দেশ্য করে লেখা। এর বাইরে যারা পড়বেন, টেলিভিশন সম্পর্কে তাদের কিছু নতুন ধারণা হতে পারে। কারণ এটা দর্শকের প্রতিদিনের প্রশ্ন- আগের মত সুস্থ, সুন্দর, রুচিশীল, জনপ্রিয় নাটক এখন কেন নির্মিত হচ্ছে না?

আমাদের সিনেমার এক সময় সোনালি অতীত ছিল। কিছু অযোগ্য এবং স্বার্থপর লোকের আধিপত্যে আমরা সে অতীত হারিয়েছি। পরবর্তীতে টেলিভিশন নাটক দেশের অধিকাংশ মানুষের সুস্থ বিনোদনের মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং আস্থা অর্জন করে।

বিভিন্ন সময়ে নানা সংকট পার করে টেলিভিশন শিল্প একটি শক্ত অবস্থান তৈরী করতে পারলেও পূর্ণাঙ্গ পেশাদারিত্ব কখনই এই মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে টেলিভিশন নাটকও এক সময় বাংলা সিনেমার মতোই কিছু সুবিধাভোগী অযোগ্য মানুষের দখলে চলে যায়। সুস্থ, সুন্দর ও পরিশীলিত টেলিভিশন নাটকের ধারাটি নানা চক্রে পড়ে, নিজস্ব শিল্প ও  সৌন্দর্য হারাতে থাকে। সেগুলো ঘ‌টে‌ছে আমাদের চোখের সামনেই।

দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে শিল্পের খোলস থেকে টেনে বের করে নাটককে শুধুই ব্যবসার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। অধিকাংশ চ্যানেল, এজেন্সী, প্রডিউসার, ডিরেক্টর, কলাকুশলী শুধু নিজেদের স্বার্থ আর ব্যবসা দেখতে গিয়ে, প্রকৃত ভালো আর মন্দের পার্থক্য গুলিয়ে, টেলিভিশন নাটককে অখাদ্যে পরিণত করেছে। আস্তে আস্তে টেলিভিশন নাটককে, শিল্পের মাপকাঠি থেকে বের করে এনে ভিউয়ের মাপ কাঠিতে মাপা শুরু হয়েছে।

ভিউ আর টিআরপি-এর দোহাই দিয়ে এর চক্করে পড়ে আমরা আমাদের নাটকের মান কোথায় নামিয়ে ফেলেছি সেটাও মনে রাখা দরকার।

ইদানীং ভালো টেলিভিশন নাটকের সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে, তা দিয়ে এত বড় একটা ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে না। এ ক্ষেত্রে সকলেরই সমান দায় রয়েছে। শুধু ভিউ না দেখে সংশ্লিষ্ট সকলেরই নাটকের মানটা দেখা অনেক বেশি জরু‌রি বলে আমি মনে করি।

প্রত্যেকটি টেলিভিশন চ্যানেল বা নাটক ব্যবসায়ীরা নাটকসহ বিভিন্ন কন‌টেন্ট দিয়ে আয়ের নতুন পথ খুঁজে পেতে ইউটিউব চ্যানেল খুলে বসেছে। সেখানে ভিউ ব্যবসা বেশ জমেও ওঠেছে। ব্যবসার কায়দা যেমন বেড়ে চলেছে নানাভাবে, সেই সাথে নাটকের বাজেটও কমেছে অবিশ্বাস্য গতিতে। কেউ হয়তো বিশ্বাসই করবেন না, ১০ বছর আগে নাটকের যে বাজেট ছিল এখন তা চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে বাজেটটুকু বরাদ্দ হচ্ছে চ্যানেল থেকে তা চু‌ক্তি প্রথার প্যাঁচে পড়ে, অর্ধেক চলে যাচ্ছে এজেন্সী, প্রডিউসার ও ডিরেক্টরদের পকেটে। কোনো ম‌তে বাকি টাকাটুকু দিয়ে, ’ধর তক্তা মার পেরেক’ পদ্ধতিতে নাটক নির্মাণ হচ্ছে।

সম্মানিত অধিকাংশ ডিরেক্টরগণ এখন নাটক নির্মাণের কন্ট্রাক্টর হয়ে গেছেন। যে কারণে বাজেট স্বল্পতার জন্য তিন দিনের কাজ একদিনে করতে গিয়ে কলাকুশলীসহ সকলের প্রাণ ওষ্ঠাগত। নাটকের গুণগত মান রক্ষা এই কার্য ধারাবাহিকতায় সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। হাতে গোনা কিছু অভিনয় শিল্পীর ভিউ আর টিআরপি কে পুঁজি করে চলছে এই নাটক ব্যবসা। তাতে করে অনেক যোগ্য অভিনেতা অভিনেত্রী, ডিরেক্টর, প্রডিউসাররা হচ্ছেন বঞ্চিত। আর যোগ্য নাট্যকাররা তো অপ্রয়োজনীয় বস্তুতে পরিণত হয়ে গেছেন। কারণ তথাকথিত নাটক নির্মাণ করতে কোনো চিত্রনাট‌্য লাগে না। সে কারণেই ভালো নাট্যকারের সংখ্যা বাড়েনি। হাতে গোনা কয়েকজন নাট্যকারকে আমরা জাদুঘরে সাজিয়ে রেখেছি।

পেশাগত যোগ্যতা বিচার করে খুবই কম কাজ হচ্ছে। ব্যক্তিগত লেনদেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাটককে প্রভাবিত করছে। যার যার সুবিধা বুঝে অধিকাংশ মানুষ চুপ করে আছে, মুখ খোলারও প্রয়োজন বোধ করছে না। টেলিভিশন নাটকের বিভিন্ন সংগঠন নানা কার্যক্রম নিয়ে নানা ব্যাপারে সচেতন থাকলেও নাটকের বাজেট ও সার্বিক মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে করণীয় পথ এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি। টেলিভিশন নাটকের দেয়ালে আসলে অনেক আগেই শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেছে।

দেশী বিদেশি ও‌টি‌টি প্ল‌্যাটফর্ম বা ওয়েব চ্যানেলগুলো আমাদের টেলিভিশনের দুর্বল জায়গা মানে অসুখটা বুঝতে পেরেছে।সেভাবেই তারা আগাচ্ছে। কে টিকে থাকবে?

টেলিভিশন নাকি ও‌টি‌টি প্ল‌্যাটফর্ম? যারা দর্শককে ভালো কিছু দেবে তারাই টিকে যাবে।

আমাদের দেশে কিন্তু ওয়েব চ্যানেলের দর্শক নেহাতই কম নয়। আগামী দুই বছরে সব হিসাব কিন্তু গড়মিল হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই টেলিভিশন ইন্ডা‌স্ট্রির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল মানুষ এবং দর্শক কেউই চান না আমাদের টেলিভিশনও সিনেমার ম‌তো তলিয়ে যাক। আমাদের টেলিভিশনগুলো যদি ওয়েব চ্যানেলগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে আগাতে চায়, টিকে থাকতে চায় তাহলে নতুন করে ভাবা খুবই দরকার।

টেলিভিশন নাটকের সেই গ্রহণ যোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে, নতুন সময়ে টিকে থাকতে এখন আশু প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, যোগ্য মানুষ, যোগ্য বাজেট। যেহেতু দীর্ঘদিন টেলিভিশনে কাজ করছি টেলিভিশনকে ভালোবাসি এই কথাগুলো বলা আমি আমার দায়িত্ব মনে করছি। আমার কথায় কেউ কষ্ট পেলে ক্ষমাপ্রার্থী। সংশ্লিষ্ট সকল সংগঠন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সাথে আলোচনা করে তার অসুখ সারিয়ে তুললেই বেঁচে যাবে আমাদের টেলিভিশন নাটক, বাঁচবে টেলিভিশন ।

লেখক: অভিনেতা।