বিনোদন

অপুর চলে যাওয়া না যাওয়া

আর কিছু নয়, তিনি শিল্পী হতে এসেছিলেন। সাধারণ বাঙালির চেয়ে অনেকটাই আলাদা। পর্দা কিংবা মঞ্চ। কবিতার খাতা কিংবা অন্যের কবিতা পাঠে। কথা বলায়, আচরণে, তিনি স্নিগ্ধ রুচিবান। তিনি বাঙালির চিরকালীন অপু।

তার এই চলে যাওয়া, অগস্ত্যযাত্রা, প্রস্থানে ব্যক্তিগতভাবে আমি এক ধরনের আনন্দ পাচ্ছি। কেন না, অসাধারণ কর্মময়জীবন যাপনকারী মানুষটি হাসপাতালে কৃত্রিমভাবে একটু বেঁচে আছেন, এটা আমায় স্বস্তি দিচ্ছিল না। তাই তার চলে যাওয়ায় আর যা হোক, তাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিলো তো। তিনি এক বাঙালি শিল্পীজীবন থেকে অনন্তের অন্যজীবনে, অন্যভূবনে যাত্রা করলেন। তার অনন্ত যাত্রায় শুভেচ্ছা। গুডবাই বাঙালির অপু, ফেলু দা আরো কত কী!

অপুর সংসারের সেই দৃশ্যটার কথা মনে আছে? ওই যে অপু সন্তানকে ঘাড়ে তুলে হেঁটে যাচ্ছেন নতুন সময়ের দিকে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে আরেক অন্যরকম বাঙালি সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেছিলেন ‘অপুর সংসার’। দৃশ্যটা কেবল বাংলা নয়, পৃথিবীর সব সিনেমা জোড়া দিয়ে বিবেচনা করলেও বাবা-সন্তানকে নিয়ে ধারণ করা এটা একটা সেরা চিত্রই বটে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্ট নীড়’ কে সত্যজিৎ বানিয়েছেন ‘চারুলতা’। এখানে অন্যরকম রোমান্টিক খেয়ালি এক তরুণ বাঙালির অপু। নতুন এক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে পেল বাংলা সিনেমার দর্শক। অথবা সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট আরেক মাস্টারপিস- ‘হীরক রাজার দেশে’। উৎপল দত্ত, রবি ঘোষদের পাশাপাশি সৌমিত্র হীরেন পণ্ডিত হয়ে চিরকালের জায়গা করে নিলেন।

আবার ‘অশনি সংকেত’-এ বাংলায় আকালকালে অবাক এক ব্রাহ্মণ চরিত্রে বাংলাদেশের সুপারস্টার ববিতার সঙ্গে অন্যরকম এক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’—এসব চলচ্চিত্রে একদম নিজের মতো করে জায়গা পেয়েছেন তিনি। অন্য কাউকে সৌমিত্রের জায়গায় ভাবাই যায় না। এসবের বাইরে রকের আড্ডা বাজ, খল চরিত্র এবং নিতান্তই গল্পবলা বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে বানানো সিনেমায় অভিনয় করেও মাত করে দিয়েছেন তিনি।

বাঙালির গড়পড়তা আয়ুতে অনেকটা বয়েস হয়েছিল তার। তারপরও কাজ থেমে থাকেনি। বাজে সময় পেরিয়ে কলকাতার সিনেমা যখন নতুন সুর পেল, তখন তিনি তরুণদের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে একের পর এক অভিনয় করে গেলেন এবং সবকটিতে সৌমিত্রের অভিনয় দেখার মতো।

চলচ্চিত্রের বাইরে তিনি মঞ্চ, বেতারের শিল্পী। দারুণ কবিতা আবৃত্তি করতেন। কবিতা লেখতেন এবং সম্পাদনা করতেন কাগজ। এত কিছু পারতেন তিনি। প্রকৃত অর্থে শিল্পী বলতে যা বোঝায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই জন। স্নিগ্ধ হাসিতে ভরিয়ে রাখতেন নিজেকে। তার কাছে গেলে বিপদগ্রস্ত মানুষ এক ধরণের শুশ্রূষা পেত। কলকাতা শহরে একটা অন্যরকম, কর্মময়জীবন যাপন করেছেন তিনি। তার হাত ধরে সময় হেঁটেছে। ইতিহাস হেঁটেছে।

তাই তার চলে যাওয়া, তার সপ্রাণ অনুপস্থিতি নানাভাবে অনুভূতিপ্রবণ, সৃষ্টিশীল বাঙালিকে ভাবাবে, কষ্ট দেবে, অনেককে আশ্রয়হারা করে তুলবে। এটাতো ঠিক যে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কোনো তুলনা হয় না। তাই অনেক অনেক দিন, যদি দুনিয়াটা ঠিকঠাক টিকে থাকে, যদি মারি, মহামারি থেকে বেঁচে যায় মানুষ, বাঙালি তাহলে সৌমিত্র  চট্টোপাধ্যায়কে বার বার মনে করবেই; তার কাজের কাছে যেতেই হবে। কেন না, তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন অনেক অনেক কিছু।

তার সময়, তার কাজ, তার জীবন এবং জীবনআচরণ নিয়ে ভাববার সময়টা শুরু হলো এখন থেকে। আপনি এক অমলিন বাঙালি শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আমাদের প্রয়োজনেই আপনাকে আমাদের পাশে রাখতে হবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।