বিনোদন

আপনাকে নিয়ে লিখবো সঞ্জীব

ফোনে ‘মেসবাহ য়াযাদ’কে বলে দিলাম লিখবো না। ব্যস্ত সময় পার করছি, হাতে অনেক কাজ। ফোন নামিয়ে রেখে হঠাৎ ঘুরেই দেখি দুপুরে শাহবাগে মৌলি থেকে বের হচ্ছেন সঞ্জীব, সঞ্জীব চৌধুরী। গায়ে কেমন ফ্যাকাশে নীল রঙের পরিচিত জ্যাকেট। শীত খুব কাছেই তো। হেমন্তের হাওয়ায় চুল খানিকটা এলোমেলো। -লিখবেন না আমাকে নিয়ে? হাসপাতালের হিমঘরে আপনার শান্ত শরীর। মাথাটা নিপুণ কামানো, শীতের অরণ্যের মতো পত্রহীন। চোখ বন্ধ সঞ্জীব আপনার। কপালে হাত রাখি। ঠান্ডা। জ্বর থেমে গেলে কবিরা এত শান্ত হয়ে ঘুমায় সঞ্জীব? কবিরা এত নিষ্ক্রমণপ্রিয় হয়! -কথা বললেন যে আমার সঙ্গে? আপনার সঙ্গে তো চলে যাবার এক বছর আগে থেকে বাক্যালাপ বন্ধ ছিলো আমার! -অনুপস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে যেতেও কথা বলা যায়, কথা হয়। -খুব রাগ করে কথা বলিনি আপনার সঙ্গে। কিন্তু আপনি আশ্চর্য মানুষ। কথা বলতে চাইতেন আমার সঙ্গে। কাজ করছি ডেস্কে রাখা কম্পিউটারে। পাশ দিয়ে যাবার সময় প্রশ্ন ফেলে রেখে গেলেন, ‘কেউ চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারে সন্ধ্যাবেলা সাকুরায়।’ তখন কেন জানিনি সঞ্জীব আর কোনোদিন কথা হবে না আমাদের? জীবনের নাম অভিমান পাল্টে রাখবো-আর দেখা হবে না! -কোথায় যাচ্ছি আমরা? -চলেন না...সামনেই। আপনার গোঁফের তলায় হাসিটা মিস্টিরিয়াস। কেমন এক বিষণ্ন হাওয়ায় উড়ছে শাহবাগ, ক্যাম্পাস আর নীলক্ষেত। -আচ্ছা, আমি যদি বেঁচে থাকতাম তাহলে আর কথা বলতেন না আমার সঙ্গে? -বলতাম তো। আমাদের কত কথা অভুক্ত হয়ে পথে পথে ঘুরলো এতগুলো বছর। রাত-বিরাতে নিজের বাড়ির ঠিকানা খোঁজা মানুষ আপনি। রাত্রি গভীর হলে পিজির মোড়ের জটলায়, নিঃসঙ্গ বাংলা মটরে আমাদের অতীত সেঁটে থাকলো। প্রথম দেখার দিনেও তো সামান্য দু একটা কথা হয়েছিলো আমাদের। আপনার কবিতার বইটা দিয়েছিলেন মনে আছে? রাসপ্রিন্ট। কেন বই দিয়েছিলেন সঞ্জীব? আমাদের গোটা জীবনটাই এক রাসপ্রিন্ট। বয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে দৃশ্যের পর দৃশ্য। সিঁড়ি ভেঙে নামছেন আপনি। -চলেন, সিগারেট খেয়ে আসি। ভোরের কাগজের সামনের রাস্তায় সন্ধ্যায় দেখা। -হবে নাকি? -টিএসসির মোড়ে যাবেন? পিঁয়াজু খাবো। -এই দুপুরে পিঁয়াজু! -এটাই তো সময়, কী বলেন? শীতের আগমন কালে বাতাসে আভিমানে উড়ে আসে। মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান গাইছেন। একে তাকে দেখে হাসি বিনিময়। এতগুলো বছর আপনি বলে সম্ভাষণ করতাম একে অপরকে আমরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে, আড্ডার টেবিলে, টিয়ারগ্যাসের ঘন আবরণ ভেদ করতে করতে আপনি ছিলেন তো সঞ্জীব। দূরে থেকেও কাছে ছিলেন। ‘চাইলে কেউ যেতে পারে আমার সঙ্গে’, কোথায় সঞ্জীব, কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সেদিন আমাকে? অভিমান এতটাই উঁচু দেয়াল? গেলাম না আমি আপনার সঙ্গে। -চা খাবেন? সন্ধ্যা নামছে ক্যাম্পাসে। আমরা অনেকক্ষণ বসে আছি। আপনি আর আমি পাশাপাশি একটা কাঠের বেঞ্চিতে। আপনার মাথায় একটাও চুল নেই। ব্যান্ডেজ বাঁধা। হিমঘরে ছায়া ছায়া কারা দাঁড়িয়ে আছে? এবার শীতে ফ্যাকাশে নীল জ্যাকেটটা পরবেন না আপনি? রিকশায় চড়ে আমরা কোথাও যাবো না আর? ফোনে বলেছিলাম লিখবো না আপনাকে নিয়ে। কেন তখন প্রশ্ন করলেন, ‘লিখবেন না আমাকে নিয়ে?’ লিখবো সঞ্জীব। এক জীবন অসমাপ্ত গল্প আমাদের এই শহরে। লিখবো আপনাকে নিয়ে। আজ আপনার মৃত্যুবার্ষিকী। কী লিখি আপনাকে নিয়ে আমি?

 

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক