বিনোদন

সিনেমার মহরত, ‘মুরগি’ বানানোর ফাঁদ

গত এক দশক ধরে ঢাকাই চলচ্চিত্রে মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে। নতুন সিনেমা না-থাকায় পুরোনো সিনেমা দিয়ে হলগুলো চালু রাখা হয়েছে। প্রতিনিয়ত হল মালিকদের গুনতে হচ্ছে লোকসান। যে কারণে সময়ের সঙ্গে বন্ধ হচ্ছে প্রেক্ষাগৃহ। সিনেমা নির্মাণের সংখ্যা কম হলেও প্রতি বছর কয়েকশ সিনেমার ঘোষণা ও মরহত অনুষ্ঠিত হয়। যার অধিকাংশ সিনেমা শুধু মহরতেই সীমাবদ্ধ থাকে, কোনোদিন আর আলোর মুখ দেখে না। চলচ্চিত্রপাড়ায় এসব সিনেমাকে ‘মহরত সিনেমা’ বলে থাকেন।

মহরত করেই সিনেমা শেষ। বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও এসব সিনেমার শুটিং শুরু হয় না। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়, নায়িকা নিয়ে আউটডোরে গিয়ে কয়েক দিনের শুটিং করেই শেষ! সিনেমা আর মুক্তি পায় না। পাবে কীভাবে? শুটিংই তো শেষ হয় না। অথচ জিজ্ঞেস করলেই মুখস্ত বলেন—‘শুটিং হচ্ছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব সিনেমার শুটিং আর হবে না। কিন্তু কথায় কথায় সিনেমার মহরত কেন করেন সংশ্লিষ্টরা? যদিও এই প্রশ্নের উত্তর সহসাই মিলবে না। সিনেমার মহরত মানেই একটি অনুষ্ঠান। আর অনুষ্ঠান মানেই সেখানে অনেক লোকের আমন্ত্রণ পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি। অধিকাংশ মহরত অনুষ্ঠানে সংবাদকর্মীদের পা রাখার জায়গা পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। তা হলে মহরত অনুষ্ঠানে এত অতিথি কারা? মহরত অনুষ্ঠানে প্রযোজকের আত্মীয়-স্বজন, বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি বেশ লক্ষ্যণীয়। আর এসব অতিথির উপস্থিতি মানেই নিজেকে জানান দেওয়া। বর্তমানে মহরতের প্রধান লক্ষ্য—নিজেকে জাহির করা। মহরত করা মানেই পরের দিন সংবাদমাধ্যমে ছবি প্রকাশ। অন্যকোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে এত সহজে সংবাদমাধ্যমে নিজেকে দেখানো হয়তো সম্ভব নয়!

এদিকে মহরত মানেই কথিত প্রযোজকদের ‘মুরগি’ বানানোর একটি ফাঁদ বলে কথিত রয়েছে এফডিসিতে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, কথিত প্রযোজক সিনেমা প্রযোজনা বা নির্মাণ সম্পর্কে খুব একটা ধারণা রাখেন না। অন্যদিকে নায়িকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর কেউ কেউ। তারা ‘প্রেমিককে’ সিনেমায় অর্থলগ্নি করতে দিন-রাত অনুরোধ করেন। আর ‘প্রেমিকাকে’ খুশি করতে একসময় রাজি হয়ে যান কথিত প্রযোজক। যে কথা সেই কাজ! সিনেমা শুরুর আগে ধুমধাম করে মহরত অনুষ্ঠিত হয়। নতুন নায়িকা হিসেবে পরিচিতি পান। মহরতে কয়েক লাখ টাকা খরচ করেন কথিত প্রযোজক। এরই মধ্যে নায়িকা তকমা লেগে যায়। কিঞ্চিৎ এই পরিচিতি নিয়ে নবাগত এসব নায়িকারা ঘুরেবেড়ান দেশ-বিদেশে। বাস্তব জীবনেও কথিত এসব নায়িকাদের পরিবর্তন আসে। সিনেমার মহরতের আগে তারা রিকশা অথবা সিএনজিতে বিএফডিসিতে আসতেন। এখন তারা দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ান। নায়িকা তকমা লাগিয়ে তারা দুদিন পরপর বিদেশ ভ্রমণে যান। কোনো কাজ না করেই এত টাকা কোথায় পান এই নায়িকারা?

এছাড়া অনেক অশোভন ইচ্ছে নিয়ে সিনেমায় অর্থলগ্নি করতে আসেন অনেকে। দু-চারজন শিল্পী নিয়ে সিনেমার মহরত করে অতিথি পাখির মতো হারিয়ে যান। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বোঝানো হয়, কম বাজেটে সিনেমাটি নির্মাণ করা যাবে। কিন্তু শুটিং শুরুর পর তারা বুঝতে পারেন বাজেট অনেক বেশি প্রয়োজন। তখন কৌশলে প্রযোজক সরে দাঁড়ান। তবে পেশাদার প্রযোজকরা কারো দ্বারা প্ররোচিত না হয়ে পরিকল্পনা মাফিক সিনেমা প্রযোজনা করে থাকেন। আর এসব সিনেমাই আলোর মুখ দেখে, প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়।

চলতি বছরের প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে। এর মধ্যে বিশটি সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা এসেছে। কয়েকটি সিনেমার শুটিংও শুরু হয়েছে। মনোয়ার হোসেন ডিপজল আগে থেকেই বেশকিছু সিনেমা প্রযোজনার ঘোষণা দিয়ে আসছেন। আদতে এসব সিনেমা নির্মাণ পর্যন্ত গড়ায়নি। এদিকে বছরের শুরুতে সাতটি সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা দেন তিনি। এর মধ্যে ‘মানুষ কেন অমানুষ’ সিনেমার শুটিং শুরু করেছেন। অন্যদিনে পরিচালক অনন্য মামুন পাঁচটি সিনেমা পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছেন। এখনো এসব সিনেমা নির্মাণের কাজ শুরু করেননি। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান শাপলা মিডিয়া নিয়মিত সিনেমা নির্মাণ করছে। নির্মাণের পাশাপাশি নতুন সিনেমা নির্মাণের ঘোষণাও অব্যাহত রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। নতুন বছরের শুরুতে তিনটি সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে শাপলা মিডিয়া।

এর কিছুদিন পর প্রযোজক ইকবাল তিনটি সিনেমা পরিচালনার ঘোষণা দেন। ঘটা করে মহরত করেন তিনি। কবে নাগাদ এসব সিনেমার শুটিং শুরু হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। এছাড়া বেশ কয়েকটি সিনেমার শুটিং বর্তমানে চলছে। এসব সিনেমা সঠিক সময়ে নির্মাণ ও বছরের বাকি সময় এই ধারাবাকিতা অব্যহত থাকলে সিনেমা সংকট কিছুটা হলেও লাগব হবে। এছাড়া গতবছর প্রায় দুই ডজন সিনেমার শুটিং শেষ করে মুক্তির অপেক্ষা রয়েছে। বিগ বাজেটের এসব সিনেমা ২০২১ সালে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আনন্দের খোরাক জোগাবে বলে মনে করছেন চলচ্চিত্র বোদ্ধারা।