রাহাত সাইফুলঢাকা, ২৫ ফেব্রুয়ারি : সেটি ছিল ফারুক রহমান পরিচালিত আগুন্তক ছবি। এতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন আজকের বর্ষীয়ান অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক। তার লিপের গান ছিল সেটি। গানটির রেকর্ডিংয়ের দিন তরুণ কণ্ঠশিল্পীকে দেখে অনেকেই বললেন, ‘এই ছেলে কী গান গাইবে!’
উপস্থিত সকলের কথা শুনে ঘাবড়ে গেলেন ছবির প্রযোজক। তবে তার স্ত্রী নিজ সিদ্ধান্তে অটল। সেই তরুণকে দিয়েই তিনি গানটি গাওয়াবেন। তার যুক্তি যে ছেলেটি বেতারে প্রচারিত ‘তোমার দু হাত ছুঁয়ে শফথ নিলাম’ গানটি করেছে সেই পারবে রাজ্জাকের লিপের গানটি গাইতে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে গান রেকর্ড না করেই স্টুডিও থেকে ফিরে যান ছেলেটি। নাম তার খুরশীদ আলম। সম্প্রতি জীবন্ত এই কিংবদন্তী প্লেব্যাক শিল্পীর মুখোমুখি হয়েছিলো রাইজিংবিডি। তার সঙ্গে আলাপচারিতার সুত্র ধরেই এই বিশেষ রচনা।
এক নজরে খুরশীদ আলমপুরো নাম : মো. খুরশীদ আলম জন্ম : ১ আগস্ট, ১৯৪৬ সালজন্মস্থান : জয়পুরহাটবাবা : এ এফ তসলিম উদ্দীন আহমেদমাতা : মেহেরুন নেছাদুই কন্যার বাবা তিনি।বড়মেয়ে : মেহেরীন আলমছোটমেয়ে : মেহনাজ আলমপ্রিয় উক্তি : যে হতাশায় ভুগবে তার মত বেকুব দুনিয়ায় আর নেই।
সুখস্মৃতির ঝুড়ি হাতড়ে খুরশীদ আলম শোনান তার শিল্পী জীবনের শুরুর দিকে কথা। তিনি জানান, প্লেব্যাক স্বপ্ন সেদিন ভঙ্গ হলো। তবে গানটি সেদিন রেকর্ডিং না হলেও চলতে থাকে তার প্রশিক্ষণ। ওইদিনই রাজ্জাক তাকে সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে যান তাকে। তাও আবার নিজের গাড়িতে তার পাশে বসিয়ে। রাজ্জাক নিজেই গানটির গাওয়ানোর জন্য তৈরি করতে লেগে গেলেন।
খুরশীদ আলম বলেন, রাজ্জাক সাহেব কিভাবে হাসতে, কিভাবে কথা বলতেন, কেমন ব্যবহার করতে দাড়োয়ান অথবা গাড়িচালকের সঙ্গে সবই খেয়াল করতে বলা হল আমাকে। এমনকি তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে কিভাবে কথা বলতেন বা কেমন ছিলো তার ভাবের প্রকাশ সবই দেখানো হলো আমাকে। আমিও মনোযোগী ছাত্রের মত নিজের ভিতরে ধারণ করতে থাকলাম রাজ্জাক সাহেবকে’।
এর পর তিনি ঠিকই আগুন্তক-এর গান ‘বন্দি পাখির মত মনটা কেঁদে মরে’র জন্য কণ্ঠ দিলেন। সেই থেকে প্লেব্যাক সিংগার হিসেবে পরিচিতি পেলেন খুরশীদ আলম। তবে এ নিয়েও ছিলো নানা জনের নানা মত। গানটি রেকর্ডিং হওয়ার আগে অনেকেরই আপত্তি ছিলো। তবে নিজ সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন গানটির সুরকার আজাদ রহমান। নিজ দায়িত্বে তিনি খুরশীদকে দিয়ে গান করালেন। সেই কথা আজও ভুলেননি ঢাকাই সিনেমার তুমুল জনপ্রিয় প্লেব্যাক সিংগার খুরশীদ আলম।
তিনি বলেন, ‘আমি আজাদ রহমান সাহেবর কাছে অনেক কৃতজ্ঞ’। সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পরে তার গাওয়া প্রথম সিনেমার গানটি হিট করে। এক সময় তা ছড়িয়ে পরে মানুষের মুখে মুখে।
ঢাকাই ছবির এক সময়ের ডাকসাইটে কণ্ঠশিল্পী খুরশীদ আলমের দ্বিতীয় সিনেমা পিচ ঢালা পথ । এই ছবিতে তিনি কণ্ঠ দেন ‘আমি পাগল পাগল দুনিয়ায়’ গানটিতে। আর তৃতীয় ছবি সাধারণ মেয়ে। সিনমাটির নায়ক ছিলেন সে সময়ের আলোচিত মুখ জাফর ইকবাল। এর পরই আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। চলচ্চিত্রের সংগীতাঙ্গনে স্থায়ি জায়গা করে নেন তিনি।
এরপর তিনি পাকিস্থান বেতারে অডিশন দিলেন। অডিশনের সময় উপস্থিত ছিলেন আবদুল আহাদ, ফেরদৌসি রহমানসহ অনেকে। অডিশনে গিয়ে একে একে তিনি গাইলেন ছয়টি গান। গান করছেন আর ভিতর ভিতর ভয়ও কাজ করছে। কারণ তুনে তো মাত্র সাতটি ধনুক। ছয়টি ছুড়ে দেওয়ার পর বাকি মাত্র একটি। সেটিও যদি গাওয়ার পরে যদি আরেকটি শুনতে চান বিচারকরা! ভিতর ভিতর তখন ভয়ের পাশাপাশি ক্ষোভও কাজ করছিলো তার। মেজাজ তখন সপ্তমি ছাড়িয়ে অষ্টমীতে যায় যায়।
৬৮ বছর বয়সি এই কণ্ঠশিল্পী বলছিলেন, তার সংগীত জীবনের শুরুর কথা। নিজের কথা বলতে বলতে কিছুটা নড়েচড়ে বসলেন। ঠাট্টা করার ছলে বললেন, ‘গানের ওস্তাদ আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘বাবা রাগিসনা একটা কিছু হবে’।
সেদিন গান গেয়ে স্টুডিওয়ের বাহিরে এলে সংগীত পরিচালক সমর দাস বলেন, ‘তোমার গলাতো খুব ভালো, তুমি কাউকে অনুসরণ কর। যতদিন ঐ শিল্পী জীবিত থাকবে ততোদিন তোমাকে কেউ বলবে না খুরশীদ আলম গান করছে। তবে ওই শিল্পীর মৃত্যুর পর তোমাকে লোকে চিনবে তোমার নামেই’।
এর পর সমর দাসের বাসা গিয়ে তিনি গান শিখতে শুরু করলেন। তার ভাষায়, ‘আমি সকাল সাতটায় যেতাম। তিনি টানা ছয় মাস আমাকে সা রে গা মা শিখান। সবচেয়ে বড় কথা সে আমার কাছ থেকে কোন টাকা নেননি। যেটা এই সময় কেউ করেন না’।
‘১৯৬৭ সালে প্রথম বেতারে গান গাইতে গেলাম এবং প্রথম গান রের্কড হয় । তখন একদিনে দুইটা গান রের্কড হয়। একটি হলো ‘তোমার দু হাত ছুঁয়ে শপথ নিলাম’ এবং অন্যটি ‘চঞ্চল দুনয়নে’। দুটি গান ছিলো দুরকমের। এর মধ্যে ‘তোমার দু হাত ছুঁয়ে শপথ নিলাম’ গানটি বেতারে প্রচার হওয়ার পরে তা খুব জনিপ্রয় হয়। তখন এখানে কোন গানের রেকর্ড করা হতো না। শিল্পী সরাসরি গান করতেন। এখানে যে গানগুলো জনপ্রিয়তা পেতো সেগুলো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রেকর্ড করে আনা হতো। এরপর তা এখানে বাজারজাত করা হতো। শুধু ঢাকাতেই নয় আমার গাওয়া এ গানটি পুরো পাকিস্থানে জনপ্রিয়তা পায়।’ তখন খুরশীদ আলম ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ছিলেন।
তার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল স্মৃতিগুলো একটি হলো ৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পরে আতাউর রহমান, ফেরদৌসি রহমান, আবদুল আলিম প্রমুখের সঙ্গে দলীয় গানের পরিবেশনা। সেদিন তারা একে পরিবেশন করেন সংগ্রাম সংগ্রাম চলবে দিন রাত অবিরাম, সম্মুখ পানে চলবো মোরা করবো নাকো ভয় প্রভৃতি। তাদের সেদিনের গাওয়া গানগুলোরজন্ম আমার ধন্য হলো মাগো গানটি এখনও শোনা যায়।খুরশীদ আলম বেড়ে উঠেন পুরান ঢাকায় । নবাবপুর স্কুলে পড়তেন । সেখান থেকে এসএসসি পাস করেন। তবে তার বাসায় কেউ গান বাজনা পছন্দ করত না। তাছাড়া তাদের বাসার ঠিক পাশেই ছিলো মসজিদ। এলাকার লোকজনও ছিলেন ধার্মীক প্রকৃতির। সবমিলিয়ে গান করাটা খুব কঠিন ছিলো। যদিও ওখানে এলাকাটিতে অনেক নামিদামিদের বসবাস ছিলো। খুরশীদ আলমের ভাষায়, ‘আমার এক চাচা ছিলেন। তিনি গান করতেন। তার নাম ডা. আবু হায়দার সাইদুর রহমান। সবাই তাকে ডা.মাস্তানা নামে ডাকতো। তার লেখক নাম ছিলো ‘কুয়াশা’। তিনি রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। তার কাছেই প্রথম গানে হাতেখড়ি হয়। সে সময় সপ্তম শ্রেণীতে পড়তেন তিনি। তার স্কুলের এক শিক্ষকও রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। এই দু’জনের কাছেই রবীন্দ্রসংগীত শিখতে লাগলেন।
সে সময় সারা দেশ তিন বিভাগে বিভক্ত ছিলো। বিভিন্ন স্কুলে গানের প্রতিযোগিতা হতো। সবশেষে ফাইনালটা হতো ঢাকা কলেজে। সেই প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে ১৯৬২ ও ১৯৬৩ সালে পর পর দুই বার আধুনিক ও রবীন্দ্রসংগীতে প্রথম হয়েছিলেন এই গুণি কণ্ঠশিল্পী।
এছাড়া খুরশীদ আলম বাপ্পা মজুমদারের বাবা ওস্তাদ বারিন মজুমদারের কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি এইচএসসি পাস করেন। কলেজটির প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি। কলেজটিতে বাবু নামে এক বড় ভাই ছিলো। তার কাছে রবীন্দ্রসংগীত এবং লুৎফর রহমানের কাছে নজরুল সংগীত শিক্ষা করেন।
আশির দশকে খুরশীদ আলমদের গাওয়া গান এখনও মানুষ মনে রেখেছেন। এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তখন অনেক সিনেমা হল ছিলো, দশর্ক সিনেমা দেখতো। এখন কয়েকটি হলে সিনেমা রিলিজ পায়। তাই দর্শকরা দেখতে পারে না। তখন ছায়াছবিগুলো মুক্তি পেত বেশি। লোকে অনেক বাংলা ছবি দেখতেন। এখনো লোকের আগ্রহ আছে কিন্তু হল নেই’। এছাড়া তিনি বলেন, এখন অনেক বেশি চ্যানেল হয়ে যাওয়ায় দর্শক সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। তারা সব সময় ভাবতে থাকেন, কোনটা রেখে কোনটা দেখবেন।’
বর্তমানে গানের শিল্পীরা বেশি আসছেন বিভিন্ন চ্যানেল ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের পরিচালিত রিয়েলিটি শোয়ের মাধ্যমে। এ বিষয়েও খোলামেলা কথা বলেন অভিজ্ঞ এই কণ্ঠশিল্পী। তিনি বলেন, ‘রিয়েলিটি শোতে আমি নিজেও থাকি। অতএব দোষটা আমার ঘাড়েও পরে। রিয়েলেটি শোতে যে সব শিল্পীদের আনা হয় ঐ শিল্পীকে যদি প্রপার গাইড করা না হয় তারা টিকবে না। শুধু অডিও সিডি বের করে আর বিদেশ ঘুরিযে আনলে শিল্পী তৈরি হয় না। যারা মনে করেন অডিও সিডি বের করলাম কয়টা আর কয়বার বিদেশ ঘুরে আসলেই শিল্পী হওয়া যায় না। সে সব শিল্পীরা বেশিদিন টিকতেও পারে না। আমার দেখা মতে বাংলাদেশে বহু শিল্পী যেমন তাড়াতাড়ি তারকা হয়েছেন আবার তেমনি হারিয়েও গেছেন। এই সব শিল্পীদের যদি আগের একটি গান করতে বলা হয় তারা সেটা পারবে না। আমরা একটা গান ৩০ বার ৪০ বার গেয়ে ফাইনাল রের্কড করেছি। এখন দু-একবার গেয়েই রের্কড করে। বাকিটা ফিনিসিং করে মেশিনে। এভাবে তো আর একজন ভালো শিল্পী তৈরি হয় না।’
তিনি বর্তমানের গান সম্পর্কে বলেন, ‘আমি সবাইকে খারাপ বলবো না। এখন শিল্পীদের করার কিছু নাই, তারা ভালো গীতিকার যদি না পায় তাহলে কি করবে। যেটুকুই আছে এটাকে নিয়েই ভালো কিছু করা সম্ভব। তারাও ভালো গান করার চেষ্টা করছে। এদের গানগুলো ২০ বছর পর মানুষ মুল্যায়ন করবে। তবে নতুন শিল্পীদেও প্রশংসা করে বলেন, ‘এখন নতুনদের সময়। তাদের অনেকেই ভালো গান করছেন’।তিনি এখনো টিভি চ্যানেলে প্রচারিত সরাসরি গানের অনুষ্ঠানে গান করেন। তবে বিশেষ দিবসের আয়োজন এবং অনুরোধের আসরে গান গাওয়া ছাড়া তেমন ব্যস্ততা নেই। নতুন কোন অ্যালবাম বের হবে কি না জানতে চাইলে হেসে বলেন, কোন সুযোগ নেই। কারন হল একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ তৈরি হয়েছে’।
রাইজিংবিডি / রাশেদ শাওন