বিনোদন

কবরী আপা চলে গেলেন

অনুপ সিং মূলত ঋত্বিক ঘটকের চিন্তা-দর্শন-ছবির একনিষ্ঠ ন্যাওটা। পাঞ্জাবি নির্মাতা অনুপ পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে চলচ্চিত্রের একাডেমিক তালিম থেকে বেরিয়েই প্রথম নির্মাণ করেন ‘নেইম অফ এ রিভার’। এটি বাংলা ছবি। যদিও সিং নিজে বাংলা জানেন না, কিন্তু ঋত্বিক ঘটকের ৮টি ছবিই তাকে ‘নেইম অফ এ রিভার’ বানাতে ইচ্ছা জুগিয়েছে। এসব কথা আমি জেনেছি জনাব সিং এর কাছেই, অনলাইন চ্যাটে। তো ‘নেইম অফ এ রিভার’ হচ্ছে টোটাল ঋত্বিক ঘটক বেইজড একটি ছবি। কিন্তু বায়োপিক নয়। ঋত্বিকের ছবিগুলোই এ ছবির গল্প। ঠিক গল্পও নয়, প্রোগল্প। আবার পুরোদস্তুর প্রামাণ্যও না ‘নেইম অফ এ রিভাত।’

দেশভাগ-আইপিটিয়াই-গণনাট্য সংঘ-কমুনিস্ট পার্টি- দুই বাংলার বিচ্ছেদ ও পুনরায় সাংস্কৃতিক মিলনের আবাহন ধ্বনিত হয়েছে অনুপ সিংয়ের ‘নেইম অফ এ রিভার’ ছবিতে। তাই নচিকেতা আছেন, অনুসূয়া আছেন। আবার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর অন্যতম দুই চরিত্র রোজী ও কবরী আছেন প্রামাণ্য চরিত্রে। সম্ভবত গত শতকের নব্বই-একানব্বই-বিরানব্বইয়ের দিকে নির্মিত হয় ‘নেইম অফ এ রিভার’। ঋত্বিক প্রয়াত হয়েছেন ১৯৭৬ সালে, মাত্র ৫১ বছর বয়সে।  ‘৭৫ এ তাঁর শেষ ছবি ‘যুক্তি-তক্কো-আর গপ্পো’ নির্মিত এবং তারও ২ বছর আগে ১৯৭৩ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এসে তিনি প্রযোজক হাবিবুর রহমানের টাকায় নির্মাণ করেন অদ্বৈত মল্ল বর্মণের একমাত্র উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। যে ছবির কলাকুশলী সবাই ছিলেন বাংলাদেশের। ছিলেন রোজী, কবরী ও প্রবীর মিত্র।

অনুপ সিং তাঁর ছবির নামকরণ করে থাকতে পারেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ থেকেই। হয়তো সেখান থেকে ‘নেইম অফ এ রিভার’। এই ‘নেইম অফ এ রিভার’-এর একটি জায়গায় নারকেল কোরাতে বসে কথা বলেন তিতাসের অভিনেত্রী রোজী ও কবরী। কবরী রোজীকে বলছেন, ‘খ্যাপা মানুষ। তাই ঋত্বিকদা রে জিগাইতে পারতেছি না, আমার চরিত্র না তোমার চরিত্র মেইন চরিত্র? আমি বুঝতেছি, বড় পরিচালক কিন্তু তাই বলে আমি তখন ঢাকার ছবির এক নম্বর নায়িকা। একটা ব্যাপার না? কিন্তু ঋত্বিকদারে একথা কেমনে জিগাই? যদি ক্ষেইপা ওঠেন। কিন্তু মনের মধ্যে আমার একটা খুঁতখুঁতানি ছিলই।’

নিশ্চিত, কবরী তখন ঢাকাই ছবির নাম্বার ওয়ান মিষ্টি মেয়ে। সুভাষ দত্তের হাত ধরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন ’৬৪-তেই, কিশোরী বয়সে। ‘সুতরাং’ কবরীর বিপরীতে কাজ করছিলেন রাজ্জাক, ফারুক, উজ্জ্বল, সোহেল রানা, আলমগীর, জাফর ইকবাল... যারা কিনা নায়ক হিসেবে দর্শকের কাছে নন্দিত। প্রবীর মিত্র ছিলেন বড় ভাই, সমাজের ভালো মানুষ... মানে কখনই মেইনস্ট্রিম ছবির নায়ক নন। সেই প্রবীর মিত্রকেই ঋত্বিক ঘটক কাস্ট করলেন কবরীর বিপরীতে। প্রবীর মিত্রের সঙ্গে বিষয়টা উদ্দীপক হলেও কবরীর জন্যে তা হয়নি। কিন্তু ওই যে, ঋত্বিক ঘটক, বড় পরিচালক ক্ষ্যাপা, পাত্রপাত্রী যেই হোন না কেন, যত বড় কথিত তারকাই হোন না কেন, স্রেফ বিড়াল হয়ে থাকতে হবে ক্ষ্যাপার সামনে।

আমার ছবি ‘কাঁটা’ শুটিংয়ে যাওয়ার আগে একদিন গেলাম সেগুনবাগিচায়, বর্ষীয়ান প্রবীর মিত্রের বাসায়। কথা তুললাম, ‘প্রবীরদা, কত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এ পর্যন্ত?’ ‘তিনশো তো হবেই। সাড়ে তিনশো বা চাইরশোও হতে পারে। মনে নাই।’ ‘আমি কথা বলব শুধু একটি ছবি নিয়ে।’ প্রবীরদা বলেন, ‘জানি।’ ‘বলেন।’ ‘কি বলব?’ ‘তিতাস একটি নদীর নাম, কিশোর মালো, মালোপাড়া, ঋত্বিক ঘটক বা কো-আর্টিস্ট কবরীকে নিয়ে বলুন।’ ‘ঋত্বিকদার কথা আর আমি কি বলব? আজ পুরো পৃথিবীই জানে। আর কবরী ম্যাডামের সঙ্গে শটের বাইরে কোনো কথা হয়নি। উনার তো নাক উঁচু।’ আমি উৎসাহ নিয়ে বলি, ‘আপনি তাঁকে বিয়ে করলেন, আপবাদের বাসরঘর হলো, সন্তান জন্মাল...আপনারা নদীর পারের বালিতে কত গড়াগড়িই না করলেন!’ প্রবীরদার শরীর কাঁপে। সেদিনের তাগড়া কিশোর মালো এখন বয়স্যার ভারে ও অসুখের কোপে কম্পমান। তারপরও বলেন, ‘উনি তো ছিলেন নাম্বার ওয়ান নায়িকা। আমি হয়তো তা নই। কিন্তু অভিনেতা তো! লাস্ট করলেন ঋত্বিকদা, জগদবিখ্যাত পরিচালক। কবরী ম্যাডাম আমারে মনে হয় মেনে নিতে পারেননি। পারার কথাও নয়। উনি অনেক গুণী অভিনেত্রী। শিডিউল পাওয়াই কঠিন ছিল উনার। মিষ্টি মেয়ে বলে দেশের সবাই তাঁকে চেনে। সেই তুলনায় আমি কে? একজন পার্শ্ব-অভিনেতাই তো। কিন্তু তিতাসে ঋত্বিকদা আমাদের একসঙ্গে কাস্ট করলেন। করলেও কবরী তো কবরীই। তাই না?’

এরপর একপশলা চা-টার বিরতি। প্রবীরদাকে বললাম, ‘তিতাসে কবরীর সঙ্গে আপনার প্রথম কোন শট দিয়ে শুটিং শুরু হয়?’

প্রবীর মিত্র হেসে ফেললেন। ‘ওই যে, ঘরের মধ্যে নববধূ কবরী দাঁড়ানো, আমি ঘরে ঢোকামাত্রই কবরীর নার্ভাসনেস...’ বললাম, ‘কবরী কাঁপছেন, ধাড়কান ধাড়কান শ্বাসপ্রশ্বাস- দুবার নিজের ঠোঁট নিজেই কামড়ালেন কবরী আর আপনিও তাঁকে পাঁজাকোলা করে ধরেই বিছানায় ঢলে পড়লেন?’ প্রবীরদা হাসলেন, ‘হ্যাঁ।’

সেই মিষ্টি মেয়ে চলে গেলেন করোনার থাবায়। একদিন শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরে তাঁকে পেলাম। সম্ভবত কবরীর জীবনের ৪০ বছরের চলচ্চিত্র অধ্যায়ের উপর একটি ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী হচ্ছিল। বললাম, ‘কবরী আপা, আপনার প্রতি প্রেম, সেই কিশোরবেলা থেকেই।’ কবরী আপা বললেন, ‘বুঝছি বুঝছি। আমার ছবিগুলো দ্যাখো।’ ‘ছবিতেই তো দেখে এলাম সারাজীবন। আজকেই না সামনাসামনি পাইলাম।’

তারপর অনেক কথা এলো, রাজনীতির কথা হলো, জহির রায়হান থেকে ঋত্বিক ঘটকের কথা এলো, ঢাকাই ছবির বেহাল দশার কথা হলো... কথা কি আর শেষ হয়? কথা এগোতে থাকে ‘সুতরাং’ হয়ে ‘সারেং বউ’, ‘রংবাজ’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘সুজন সখী’, ‘দেবদাস’; ‘ক খ, গ, ঘ, ঙ’-এর দিকে। কথা ঘুরে আসে ষাটের দশক-সত্তরের দশক, আশির দশক... কবরী আমার কিশোরবেলায় ফ্যান্টাসির নায়িকা। তাই, তাঁকে সামনে পেয়ে কথা কি আর শেষ হয়?

১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ করেছিলেন, নিজে নায়ক হয়ে কবরীকে নায়িকা করেছিলেন। ২০১৮ সালে আমি ‘কাঁটা’ শুট করি একঝাঁক নতুন মুখ নিয়ে। সেই নতুন মুখদের সামনে একদিন কবরী আপার আসবার কথা ছিল আমাদের মগবাজার ‘কাঁটা’ ক্যাম্পে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তিনি আসতে পারেননি, বলেছিলেন, ‘হাসপাতালে যাচ্ছি, একজন অসুস্থ রিলেটিভকে দেখতে।’

২০২০-২১ জুড়ে চলছে করোনা মহামারি। কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত। লাখ লাখ মানুষ মারা গেছেন এরই মধ্যে। বাংলাদেশেও মৃত্যু ১০ হাজার অতিক্রম করেছে। আমরা কী জানি, এই মৃত্যুর লাগাম কবে টানা হবে? এখনো ভ্যাক্সিন আসছে, ভ্যাক্সিন আসছে খবর শুনছি গণমাধ্যমে। অপেক্ষা চলছে জীবিতদের।

কিন্তু এর মধ্যেও আমরা হারিয়ে ফেলছি মানুষকে। সব মানুষই কাছের মানুষ। তবু কোনো কোনো মানুষ অনেক বেশি কাছের, অনেক বেশি প্রিয়, অনেক গুণী। কবরী আপা তাঁদেরই একজন। যার মৃত্যু, বাংলাদেশের ক্ষতি।

আজ শোকার্ত বাতাস, কবরী আপা নেই...

লেখক: কবি, চলচ্চিত্র নির্মাতা