বিনোদন

রেহানা মরিয়ম নূরের শিল্পবোধ

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তরুণ লেখকদের উদ্দেশে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, ‘মানুষের গল্পগুলো খুঁজে বের করতে হবে।মানুষই সেই প্রাণী, যার চিন্তা, ভালোবাসার গভীরতার কোনো শেষ নেই। জীবনের অতল জলে ডুব দিয়ে সেখানে প্রবেশ করতে হবে। সেখানকার মণিমানিক্য তুলে আনতে হবে।’ ২০২১ সালে নভেম্বরে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবিটি দেখে আমার মনে হয়েছে, আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের লেখা ও পরিচালিত ছবিটি যেন হাসান আজিজুল হকের কথারই প্রতিচ্ছবি। সাদ মানুষের জীবনের গল্পই চিত্রায়ন করেছেন রেহানা চরিত্রে।ছবির গল্পটিকে এমনভাবে এগিয়ে নিয়েছেন তিনি, দেখে মনে হয়েছে এটি কোনো নারী নয়, সব মানুষেরই গল্প।

রেহানা এখানে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। একজন প্রতিবাদী নারীর অবয়ব। কলেজে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনার সাক্ষী হওয়ার পর পাল্টে যেতে থাকে রেহানার মস্তিষ্ক। এরপর থেকে হেনস্তার শিকার সেই ছাত্রীর পক্ষ হয়ে সহকর্মী এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। একপর্যায়ে ঘটনার প্রতিবাদ করতে শুরু করেন। তথাকথিত নিয়মের বাইরে থেকে সেই ছাত্রীর ন্যায়বিচার চান। পাশাপাশি স্কুলে হেনস্থার শিকার হওয়া নিজের মেয়েকে নিয়ে লড়াই করেন।

যদিও চলচ্চিত্রে রেহানা মধ্যবিত্ত নারী। একটি মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক। শুরুতেই মেডিক্যালের এক শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় স্কেলে নকল লেখার দায়ে বহিষ্কার করেন। এরপর শিক্ষকের সঙ্গে ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। যা তিনি প্রতিবাদ করেন। এ নিয়ে কর্মক্ষেত্রে পড়েন নানা ঝামেলায়। পারিবারিক টানাপোড়েন থাকার পরও নিজের আত্মসম্মান নিয়ে লড়ে যান রেহানা। তিনি বলেন, আমি এই ঘটনার সাক্ষী। আমি চুপ থাকতে পারি না। ওই শিক্ষার্থী ঘটনাটি চেপে যেতে অনুরোধ করলেও রেহানা সিদ্ধান্ত নেন তিনি নিজেই অধ্যক্ষকে বিষয়টি জানাবেন। কারণ তিনি চেয়েছেন সেই অধ্যাপককে দিয়ে দোষ স্বীকার করিয়ে নেওয়া এবং তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা, যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোনো কলেজে আর কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে এমন ঘটনা না ঘটে। এসব করতে গিয়ে রেহানা অনেকটাই আপোসহীন হয়ে উঠেন।

রেহানার এই আপোসহীন হয়ে ওঠার বিপরীত দিকও স্পস্ট লক্ষ্যণীয়। এই ছবিতে মায়ের আচরণ অনেক কঠিনভাবে দেখানো হয়েছে।নিজের মেয়েকে সময় দিতে না পারায় স্কুলে ঝামেলা বাঁধে। পারমরমেন্স ইভেন্টে মেয়ে অংশ নিতে না দেওয়া, মেয়েকে ছোট্ট কারণে কান ধরে ওঠবস করানো, ঘরে আটকে রাখা-একজন মায়ের পক্ষে তখনই সম্ভব যখন সে অত্যন্ত কঠোর এবং কঠিন মনোজগতের অধিকারী হন।রেহানা ঠিক তেমনি।

শুধু তাই নয়, ছবিতে আমি লক্ষ্য করলাম বেকার ভাইকে প্রতি মাসে টাকা দেওয়া, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ, গায়ে হাত তোলা,সহকারীর অফিসে কান পাতা সবই অস্থির চিত্র। এই চরিত্রের মধ্যে দিয়ে একজন রাগী নারী হিসেবে রেহানাকে অনেকেই বলতে চাইবেন। তবে বাংলাদেশের প্রচলিত সমাজ বাস্তবতায় এই চরিত্রগুলো আমরা প্রায়ই দেখি। 

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে আমার দেখা সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র রেহানা। অনেকেই এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু আমি বলব ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র অবস্থান। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কলিগের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে চাকরি ছেড়ে দিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পড়তে হয় রেহানাকে। একজন মানুষকে জীবনে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়৷ কিন্তু কোনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সত্যিই কঠিন৷ এ অবস্থানে অবিচল থেকে পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় তা দেখিয়েছেন রেহানা। কলিগের বিরুদ্ধে নালিশ করলে তার জীবন হুমকির মুখে পড়বে-এটা বুঝেই রেহানা বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনা করেন। তিনি অধ্যক্ষকে বলেন যে তিনি নিজেই ধর্ষিত হয়েছেন। রেহানা যতই গভীরে যেতে থাকেন, তত বেপরোয়া হয়ে উঠেন। এইভাবে ছবিটি দারুণ সাসপেন্স তৈরি করেছে|

আমরা সাধারণত ছবিতে নাচ, গান, প্রেম, মারপিট এগুলো দেখে অভ্যস্ত। অফ বিট কিংবা প্রথাগত ছবির বাইরে গিয়ে ভিন্ন ধরনের ছবি দেখলেই সমালোচনায় মেতে উঠি। তবে এ ধারণা আস্তে আস্তে পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন তারেক মাসুদ, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, গিয়াসউদ্দিন সেলিম, তৌকির আহমেদ, মাসুদ হাসান উজ্জ্বলসহ সাম্প্র্রতিক সময়ে আরও কয়েকজন তরুণ নির্মাতা। তারা নতুন কিছু ছবি নির্মাণ করেছেন- যেগুলো দেশ ও দেশের বাইরে প্রশংসিত হয়েছে। তবে এতটা সাহসী চরিত্র (রেহানা) নির্মাণে সাদ এগিয়ে গেলেন সবার চেয়ে। 

তবে এই ছবি অনেকেরই ভালো লাগবে না, আবার অনেকের ভালো লাগতেও পারে। ছবিটি সিঙ্গেল ক্যামেরা ও হ্যান্ডহেল্ড শটে শুটিং করা হয়েছে। আবহ সংগীতও সাধারণ। সেট আপ, মেকাপ সাধারণ। সাউন্ডও ন্যাচারাল। প্রতিটি দৃশ্যে বিচক্ষণভাবে রেহানার নাম ভূমিকার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি দৃশ্যে গাঢ়, ঘোলাটে নীল রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া রেহানাকে কেবল চেহারাকেই ফোকাস করা হয়েছে। পেছনের দৃশ্যগুলো অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। 

আমি বলব, ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ একটি বক্তব্যধর্মী ছবি। পরিচালক সাদ শুধু গল্পই বলতে চেয়েছেন এই ছবিতে। ছবির কিছু সংলাপ শুনলেই বিষয়টি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কিছু সংলাপ এখানে তুলে ধরছি। স্বামী: ‘আচ্ছা আমরা দুজনই চাকরি করি, কিন্তু আমরা অফিস থেকে ফিরে আমি কখনও রান্না করেছি? তুমি-ই তো রান্না করেছো আর আমি শুধুই খেয়েছি।’ স্ত্রী: ‘করনি কেন?’  স্বামী: ‘তুমি কখনও বলো নি কেন? কারণ তুমি মেনে এসেছো, এটাই নিয়ম। তুমি তোমার মাকে দেখছো রান্না করতে।তাই কর্মজীবী নারী হয়েও তুমি-ই রান্না করেছো।’

আরেকটি কথোপকথন : তুমি মিমিকে এক্সপেল করলা কেন? : মিমি পরীক্ষায় নকল করতেছিলো। : স্কেলের মধ্যে দু’একটা পয়েন্ট লিখে রাখাকে নকল বলে না, রেহানা। লাইফে এরকম ভুল সবাই করে। : দুদিন পর এই ছেলে-মেয়েগুলোর হাতে মানুষের লাইফ অ্যান্ড ডেথ নির্ভর করবে।আপনি চান ওরা এভাবে পাস করুক?

শেষ কথা, চলুন ছবিটি দেখি। রেহানা মরিয়ম নূর ছবিটি মনস্তাত্ত্বিক জীবন বর্ণনার। এই সমাজের সাধারণ আবার অসাধারণ মেয়ের জীবনের মিশেল। ছবিটির কোথাও নেই কোনো আবেগ, আতিশয্য। প্রত্যেকটি চরিত্র বাস্তব হয়ে ফুটে উঠেছে।

একনজরে রেহানা মরিয়ম নূর

২০২১ সালে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আঁ সার্তে রিগা পর্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে ইতিহাস গড়েছে রেহানা মরিয়ম নূর। গত ৭ জুলাই ‘আ সার্তে রিগা’ বিভাগে ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছে। প্রযোজনা কোম্পানি: পটোকল, মেট্রো ভিডিও অভিনয়শিল্পী: আজমেরী হক বাঁধন, আফিয়া জাহিন জাইমা, আফিয়া তাবাসসুম বর্ণ, কাজী সামি হাসান, সাবেরি আলম পরিচালক: চিত্রনাট্যকার, সম্পাদক: আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ প্রযোজক: জেরেমি চুয়া সহ-প্রযোজক: রাজিব মহাজন, সাইদুল হক খন্দকার নির্বাহী প্রযোজক: এহসানুল হক বাবু চিত্রগ্রাহক: তুহিন তমিজুল ব্যবস্থাপক: আলি আফজাল উজ্জ্বল অভিনয়শিল্পী নির্বাচক: ইয়াছির আল হক বিশ্ব পরিবেশনা: ফিল্মস বুটিক দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৪৭ মিনিট