বিনোদন

প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর: কীর্তি রেখে যেতে চায় নকশীকাঁথা

১৯৮৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়েন সাজেদ ফাতেমী। ওই সময়ে ব্যান্ড গঠনের পোকা তার মাথায় ঢুকে। গঠনও করে ফেলেন একটি দল। এরপর চলতে থাকে পড়াশোনা ও গানের চর্চা। পরে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনাকালীন যুক্ত হন থিয়েটারে। শুরু করেন সামাজিক সচেতনতামূলক নাটক ও গান। আর এসব গান গাইতেন ফোক সুরে। লোকগানের সুর ও গানের প্রতি ভালোবাসার শুরুটা সেখান থেকেই।

২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় সাজেদ ফাতেমীর একক অ্যালবাম ‘কত দিন তোমাকে দেখি না’। এ অ্যালবামের গানগুলো ছিল গতানুগতিক বিরহ ঘরানার। সংগীতা থেকে এটি প্রকাশের পর দারুণ জানপ্রিয়তা লাভ করে। তারপর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক অ্যালবাম প্রকাশের লোভনীয় প্রস্তাব পেলেও আর করেননি সাজেদ। ২০০৪ সালের দিকে এনটিভিতে বাউল গানের একটি শো উপস্থাপনার ডাক পড়ে। টিভি চ্যানেলের ডাকে সাড়া দিয়ে ‘মন আমার সন্ধান করি’ শিরোনামের অনুষ্ঠানটির কাজ শুরু করেন। এরপর আর আধুনিক গানে ফেরেননি সাজেদ ফাতেমী।

আধুনিক গানে না ফেরার কারণ ব্যাখ্যা করে সাজেদ ফাতেমী রাইজিংবিডিকে বলেন—‘এনটিভির ডাকে সাড়া দিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে শুটিং শুরু করি। দুই-তিন মাস কাজ করার পর কাজটিতে ডুবে যাই। বলতে পারেন লোকগানে পুরোপুরি ডুবে যাই! এর আগে লোকগান নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না। এর মাঝে সংগীতা থেকে অ্যালবাম প্রকাশের লোভনীয় প্রস্তাব আসতে থাকে। কিন্তু যাওয়া হয়নি। এদিকে বাউল গানের অনুষ্ঠানটির অনেকগুলো শো প্রচার হয়ে গেছে। আর প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে একেক বাউলের জীবন, গান তুলে আনতে থাকি। এরপর আর গতানুগতিক বিরহের গানে ফেরা হয়নি।’

শুধু লোকগানে ডুবে থাকা নয়। সাজেদ ফাতেমী আবারো ব্যান্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। তবে অবশ্যই তা লোকগানকে কেন্দ্র করে। সেই জার্নির কথা জানিয়ে সাজেদ ফাতেমী বলেন, ‘‘বাউল গানের অনুষ্ঠান নিয়ে গবেষণা ও উপস্থাপনার অভিজ্ঞতা থেকে ২০০৬ সালের শেষের দিকে মনে হলো ব্যান্ড গঠন করি। যদিও ব্যান্ড গঠনের পোকা মাথায় ঢুকেছে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াকালীন। যাইহোক, ফোক সুরের উপর নির্ভর করে ২০০৬ সালের শেষের দিকে ‘গানওয়ালা’ নামে ব্যান্ড গঠন করি। ২০০৭ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে দলটির আত্মপ্রকাশ করি। তখন সোশ্যাল ক্রাইসিস নিয়ে গান করতাম। নদী, বৃক্ষ, পরিবেশ বাঁচানোর গান দেশের বিভিন্ন জায়গায় কনসার্টে গাইতাম। এসব গান করে তখন মানুষের দারুণ সাড়া পেয়েছি।’’

‘গানওয়ালা’ ব্যান্ড গঠনের দুই বছর পর বদলে যায় নাম। সামাজিক ক্রাইসিস নিয়ে গান করার কারণে বেশ বাধার মুখে পড়ে সাজেদ ফাতেমীর দলটি। যা খানিকটা জটিল রূপ নেয়। সেই পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে এই শিল্পী বলেন—‘‘থিয়েটার করতে গিয়ে কিছু এনজিওর সঙ্গে কাজ করেছিলাম। সোশ্যাল ক্রাইসিস নিয়ে গান করতে গিয়ে কিছু এনজিওর রোষানলে পড়ি। তাদের ভাষ্য—‘তোমরা গানের মানুষ গান করো; ক্রাইসিস নিয়ে বলার কি আছে!’ এক পর্যায়ে তারা বেশ মারমুখি হয়ে যায়। ২০০৯ সালের দিকে ভাবলাম, এদের সঙ্গে তো মারামারি করে টিকে থাকা যাবে না! সুতরাং আমরা ক্রাইসিস নিয়ে গান গাওয়া থেকে একটু সরে যাই। কিন্তু লোকগানকে ভিত্তি হিসেবে রাখি এবং পুরোদস্তুর ফোক গানে ফিরে যাই। ২০০৯ সালের শেষের দিকে ‘গানওয়ালা’ নাম বদলে রাখি ‘নকশীকাঁথা’।’’

নকশীকাঁথার গান শুনতে ক্লিক করুন

আজ ‘নকশীকাঁথা’ ব্যান্ডের ১৫ বছর পূর্ণ হলো। দলটি বাঙালি ও বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে লোকগানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের রূপটি তুলে ধরার প্রয়াস এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। ১৫ বছর পূর্তি ঘটা করেই উদযাপন করতে চেয়েছিলেন দলের সদস্যরা। কিন্তু করোনা সংকটের কারণে তা হয়নি। এ বিষয়ে ব্যান্ডটির গায়ক সাজেদ ফাতেমী বলেন—‘নিজের গড়া ব্যান্ডের দেড় দশক পূর্তি অনেক বড় বিষয়। এ উপলক্ষে উৎসব করতে চেয়েছিলাম। এক মাস আগে থেকে পরিকল্পনাও করছিলাম। আগামী এক সপ্তাহে চারটি টেলিভিশনে লাইভ করার কথা চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু গত ৬-৭ দিনে আমাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। গত কয়েকদিনে আমিসহ ব্যান্ডের তিন সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। কাজেই সব ধরনের আয়োজন ও কনসার্ট বাতিল করেছি।’

গত ১৫ বছরে ‘নকশীকাঁথা’-এর দুটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘নজর রাখিস’। এটি ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয় ডেটলাইন মিউজিক থেকে। দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘নকশীকাঁথার গান’। লেজার ভিশন থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় এটি। অ্যালবাম ও একক গান মিলিয়ে এ পর্যন্ত তাদের ৫০টির বেশি মৌলিক গান প্রকাশিত হয়েছে। নকশীকাঁথার মুক্তিপ্রাপ্ত সর্বশেষ গান ‘তোর জন্য’। গত বছর মুক্তি পায় এটি। শৈশবের বন্দিত্ব নিয়ে সাজেদ ফাতেমীর লেখা ও সুরে নতুন একটি গান খুব শিগগির প্রকাশ করবে ধ্রুব মিউজিক স্টেশন।

এ পর্যন্ত ৮০০ বাউল গান সংগ্রহ করেছে ‘নকশীকাঁথা’। কাজ দিয়ে কীর্তি রেখে যেতে চায় দলটি। তা জানিয়ে সাজেদ ফাতেমী বলেন—‘গোটা পৃথিবীই হলো লোক সংগীতের বিচরণক্ষেত্র। আর সেই বিচরণক্ষেত্রের প্রতিটি কোণে নিজেদের কীর্তি রেখে যেতে চাই। নিজের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী লোকগানগুলোকে বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদের ঢংয়ে উপস্থাপন করে আসছি। সেইসঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোকগানগুলো দেশের দর্শকদের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি।’

ব্যান্ড দলের ভাঙা-গড়ার গল্প নতুন নয়। সাজেদ ফাতেমীর গড়া ব্যান্ডের লাইন আপে তিনবার পরিবর্তন এসেছে। তবে গত সাত বছর ধরে একই লাইন আপে চলছে দলটি। তা জানিয়ে সাজেদ ফাতেমী বলেন, ‘না ভাঙলে নতুন কিছু গড়া যায় না। এই ভাঙা-গড়া সবকিছুতেই আছে। ব্যান্ডও তার বাইরে নয়। আসলে এটি মানসিক সংকট থেকে হয়। সেই সংকট তিনবার মোকাবিলা করেছি। তবে গত সাত বছর ধরে একই লাইন-আপ বহাল রয়েছে।’

নকশীকাঁথার বর্তমান লাইন আপ হলো—ভোকাল ও পারকেশনে সাজেদ ফাতেমী। লিড গিটার, রাবাব ও ম্যান্ডোলিনে জে আর সুমন। কাহন, ঢোল ও তবলায় বুলবুল। কি–বোর্ড, হারমোনিকা ও হারমোনিয়ামে রোমেল। বেজ গিটারে ফয়সাল।