মাতৃত্ব এবং প্রকৃতি— এই দুটো শব্দ একে অপরের সমার্থক। মায়ের মমতার সাথে পৃথিবীর কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। সুমন খন্দকার পরিচালিত ‘সাঁতাও’ চলচ্চিত্রটি দেখতে দেখতে আমার চোখ বারবার ভিজে উঠেছিল। ঘটনাগুলোকে অভিনয়ের মাধ্যমে এত সুন্দর করে দর্শকের কাছে তুলে ধরা হয়েছে যে, একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে আমি বলব— অসাধারণ।
এ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে শুরু করে ছোট ছোট প্রতিটি চরিত্র এত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, নিজেকে ভেঙে চুরমার করে সেইসব চরিত্রে প্রবেশ করতে অভিনয়শিল্পীদের যেমন কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে, ঠিক ততটাই পরিশ্রম করেছেন পরিচালক নিজেও। আইনুন পুতুল এখানে অসাধারণ অভিনয় করেছেন। তিস্তাপাড়ের সাদাসিধে এক গ্রামীণ বউ তিনি। এত অপূর্বভাবে তিনি নিজের মাতৃত্বকে, মাতৃত্বের ব্যথাকে এবং ভালোবাসাকে তুলে ধরেছেন যে, দর্শক হিসেবে ওই জায়গায় চলে গিয়েছিলাম; মানে তিনি আমাকে ওইখানে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। একজন শিল্পীর সার্থকতা এখানেই। ফজলু চরিত্রে ফজলুল হকের অভিনয়ের কথা না বললেই নয়। এখানেও সেই মাতৃত্ব চলে আসে। আমি লিঙ্গভেদে যাব না। আমি এখানেও মাতৃত্ব শব্দটাই ব্যবহার করছি। তিস্তার পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে তার বাড়ন্ত ফসল যখন ভেসে যাচ্ছিল, তখন আমি তার সেই ব্যথাভরা কান্নার মাঝে মাতৃত্বকেই দেখেছি। এখানে একজন কৃষকের কাছে তার ফসল সন্তানসম।
এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে গ্রামীণ রাজনীতি, শ্রেণিভেদ, সংস্কৃতি, ঋণ পরিশোধ করতে না পারার ফলে গরীব কৃষকের করুণ পরিণতি এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, দর্শক হিসেবে আমি উত্তরবঙ্গের তিস্তাপাড়ের ওই গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম এবং ওই দুই ঘণ্টা তাদের জীবনের সাথে আমার জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘রানওয়ে’-এর পর ফজলুল হককে আমি এই চলচ্চিত্রে আবার পরিপূর্ণভাবে পেয়েছি। এই চলচ্চিত্রে সাবেরা ইয়াসমিন সীমা, শ্রাবণী দাস, সেন্টুসহ অন্যান্য পার্শ্ব চরিত্রগুলোও মন কেড়েছে।
ভাওয়াইয়া গান
‘‘কয় সার আলো চাল পারিয়ে সোনা মোর বানিয়ে কর আটা। কাইল বিয়ানে বানায়া দেও মোক গামলা কয়েক পিঠা। ওকি হায়রে হায় মনটায় মোর পিঠা খাবার চায়।’’
এবং রংপুর অঞ্চলের বিয়ের গান, বিভিন্ন রকমের পিঠা বানানোর সমারোহ সব মিলিয়ে উত্তরবঙ্গের জীবন বৈচিত্র্য দারুণভাবে ফুটে উঠেছে এই চলচ্চিত্রে। এতে লালু একটি গরুর বাছুরের নাম। তার প্রতি সন্তানহারা পুতুলের ভালোবাসা এবং হাহাকার আমাকে স্তব্ধ করেছে। খরা, বন্যা, শীত বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র ফুটে উঠেছে ছবির মতো।
এবার আসি এই সিনেমার প্রিমিয়ার শো নিয়ে। প্রিমিয়ার শো ছিল হাউজফুল। অনেক দর্শক নিচে বসে সিনেমাটি দেখেছেন, অনেকে আসন স্বল্পতার কারণে মিলনায়তনে ঢুকতে না পেরে মন খারাপ করে চলে গিয়েছেন। বাংলাদেশে একটা চলচ্চিত্র শো হাউজফুল এবং দর্শক আসন স্বল্পতার কারণে চলচ্চিত্রটি দেখতে পারলো না এটা অনেক বড় ব্যাপার। আমি বলব, এটা বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দৃষ্টিতে আসা উচিত। শো শেষে পরিচালকের আর্দ্র বক্তব্য আমার হৃদয়কে ভিজিয়েছে। এত ভালো মাপের একটা চলচ্চিত্র কেন ভালো প্রেক্ষাগৃহ পাবে না? প্রশ্নটা বারবার চলে আসছে!
গণ অর্থায়নে নির্মিত এত চমৎকার একটি চলচ্চিত্র যা প্রিমিয়ার শোতেই হাউজফুল, সেই চলচ্চিত্রটির পাশে এফডিসি বা সরকার কেন থাকবে না? যেখানে আমরা সমালোচনা করি যে, চলচ্চিত্র শিল্প ধ্বংসের পথে তাহলে সেই শিল্পের ভালো কিছুকে আঁকড়ে ধরে আমরা কেন এগিয়ে যাওয়ার কাজ করব না? এ দায় আমাদের সবার। আসুন, আরো একবার সোচ্চার হই যাতে স্টার সিনেপ্লেক্সসহ দেশের বড় বড় প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হতে পারে। সবাই যার যার জায়গা থেকে নিঃস্বার্থভাবে এমন ভালো মানের চলচ্চিত্রগুলো যেন ভালো জায়গায় প্রদর্শিত হতে পারে তার দাবি জানাই।
‘সাঁতাও’ চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার শো অসমাপ্ত চলচ্চিত্র ‘নৃ’-এর নির্মাতা রাসেল আহমেদকে উৎসর্গ করা হয়েছে। রাসেল আহমেদের ঘটনা আরো বেদনাদায়ক! ২০১৭ সালের ১৫ মে মারা যান তিনি। আমার মনে হয়, চলচ্চিত্র ‘নৃ’ নিয়ে তার মানসিক কষ্টের পরিণতি তার মৃত্যু! আর যেন কোনো রাসেল আহমেদ এমন হাহাকার নিয়ে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে না যান, এজন্য সুষ্ঠু ধারার চলচ্চিত্রগুলোর সঠিক মূল্যায়ন হোক এই দাবি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের।
লেখক: আইনজীবী ও লেখক