বিনোদন

চোখ ভেজানো বিদায়: রাজীবের অন্তিম সংলাপ

গম্ভীর কণ্ঠস্বর, কপালের গাঢ় ভাঁজ, চোখে ভয়াল দৃষ্টি— এই তিন অস্ত্রে যখন পর্দায় হাজির হতেন, তখন পুরো সিনেমা হল নিস্তব্ধ হয়ে যেত। তিনি ওয়াসীমুল বারী রাজীব। ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে অনেক খলনায়ক এসেছেন কিন্তু রাজীব ছিলেন অনন্য। শুধু পর্দায় নয়, দর্শকের মনে কেটেছেন স্থায়ী দাগ। তার প্রতিটি চরিত্র ছিল যেন সেলুলয়েডে খোদাই করা এক শিল্পকর্ম।

২০০৪ সাল। ক্যানসারে আক্রান্ত রাজীব তখন ঢাকার একটি হাসপাতালে শয্যাশায়ী। এক জীবনের অভিনয় শেষে তখন যেন জীবনের শেষ দৃশ্যের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অনেক সহকর্মী দেখতে গিয়েছিলেন তাকে, কিন্তু কেউ জানতেন না— এটাই হয়তো রাজীবের সঙ্গে শেষ দেখা।

সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে ধরা পড়ে তার অন্তিম সময়ের হৃদয়স্পর্শী মুহূর্ত। ভিডিওতে দেখা যায় রাজীব চোখের জল মুছতে মুছতে বলছেন, ‘‘আমি দীর্ঘদিন চলচ্চিত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কাজের সময় আপনাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে থাকলে, কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকেন তাহলে আমাকে মাফ করে দেবেন। আমার জন্য সবাই আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন, যাতে আমি শান্তিতে থাকতে পারি।”

এই কথাগুলো ছিল শুধু ক্ষমা চাওয়ার নয়, ছিল একজন শিল্পীর আত্মিক উপলব্ধির প্রকাশ। যিনি পর্দায় ছিলেন নির্মম খলচরিত্র, তিনি বাস্তব জীবনে ছিলেন কোমল হৃদয়ের মানুষ। মৃত্যুর প্রাক্কালে সেই মানুষটি সব অহংকার, দম্ভ ঝেড়ে শুধু একজন অনুতপ্ত মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সহকর্মীদের সামনে।

ভিডিওতে দেখা যায়, জনপ্রিয় অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন রাজীবের চোখের জল মুছে দিচ্ছেন। এটি এক মানবিক মুহূর্ত, যা শুধু সম্পর্ক নয়, শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধারও প্রতীক। 

রাজীব আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তবু যখন পুরোনো সিনেমাগুলোতে তার মুখ দেখা যায়, তখন তার অভিব্যক্তি, চোখের দৃষ্টি, হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গি— সব নতুনের মতো ফিরে আসে। তিনি আজও জীবন্ত, প্রতিটি দর্শকের স্মৃতিতে। বর্তমান প্রজন্ম হয়তো তাকে নতুন সিনেমায় দেখবে না, কিন্তু যাদের স্মৃতিতে তিনি রয়েছেন, তারা জানেন এমন শিল্পী বারবার আসে না।

অভিনয় জীবনের শুরুটা ছিল নায়ক হিসেবে। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন তার সত্যিকার শক্তি অন্য জায়গায়। ধীরে ধীরে তিনি গড়েন এক নতুন সাম্রাজ্য— খলনায়কের। তবে এই খলনায়ক কখনো একমাত্রিক ছিলেন না। রাজীবের চরিত্রে ছিল গভীরতা, মনস্তত্ত্ব, আত্মসংঘাত। তিনি হয়ে উঠতেন প্রতিহিংসাময়, আবার কোথাও একজন নিঃস্ব পিতা, একাকী মানুষ বা বিদ্ধস্ত রাজনীতিক। দর্শক পর্দায় তার খলনায়কের অভিনয় দেখে ঘৃণা করতেন। কারণ চরিত্রের সঙ্গে তিনি সহজে মিশে যেতেন। দক্ষ অভিনেতা ছিলেন। 

রাজীব জানতেন, সংলাপের বাইরেও এক ধরনের অভিনয় হয়— চোখ দিয়ে। তার চোখের দৃষ্টি যেন সংলাপের চেয়েও বলিষ্ঠ ছিল। দৃশ্যমান না হয়েও সেই চাহনি অনুভব করতেন দর্শক। তিনি ছিলেন এমন এক অভিনেতা, যিনি 'চোখের অভিনয়'কে এক নতুন স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন।

রাজীবের অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর তালিকা যেন ঢাকাই সিনেমার গৌরবময় এক অধ্যায়। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘ভাত দে’, ‘আজকের সন্ত্রাসী’, ‘অনন্ত ভালোবাসা’, ‘মগের মুল্লুক’, ‘দাঙ্গা’, ‘ত্রাস’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘খলনায়ক’, ‘স্বপ্নের বাসর’—এমন অসংখ্য সিনেমায় তিনি নিজেকে প্রতিবার নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন।