বিনোদন

জহির রায়হানের জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা

আমিনুল ই শান্ত : প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান। বাংলাদেশর চলচ্চিত্র জগতে তিনি এক প্রবাদ পুরুষ। তার সৃষ্টিকর্মই তার বড় উদাহরণ। একাধারে তিনি ছিলেন চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার এবং সাংবাদিক। আজ এই মহান মানুষটির ৭৯তম জন্মদিন। তার জন্মদিন উপলক্ষে এই সৃষ্টিশীল মানুষটির জন্য রাইজিংবিডির পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা।শৈশব ও শিক্ষাজীবনজহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সঙ্গে কলকাতা হতে বাংলাদেশে চলে আসেন।  ১৯৫৩ সালে তিনি  জগন্নাথ কলেজ (ঢাকা) থেকে আই.এস.সি পরীক্ষা দেন। ১৯৫৬-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত মেডিক্যাল কলেজ অধ্যায়ন করেন। কিন্তু কোর্স শেষ না করেই চিকিৎসাশাস্ত্র পড়া ছেড়ে দেন। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তবে তিনি প্রাথমিক লেখাপড়া করেন কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউট ও আলিয়া মাদ্রাসা থেকে।  কলকাতা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই বিয়ে করেন। ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে সুচন্দাকে বিয়ে করে সংসারী হোন তিনি। সেসময় এ দুই স্ত্রী-ই ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।পরিবারের কথা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ জহির রায়হানের দুই স্ত্রী’র একজন সুমিতা দেবী। এই প্রয়াত অভিনেত্রীর দুই ছেলে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। দুজনেই প্রতিষ্ঠিত নাট্য নির্মাতা। আরেক স্ত্রী সুচন্দা’র ছোট ছেলে তপু রায়হানও অভিনেতা। তিনি ‘সবুজ কোট কালো চশমা’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। জাহির রায়হানের ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ের নাম শমী কায়সার।বর্ণাঢ্য কর্মজীবনজহির রায়হান বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু করেন। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে, জাগো হুয়া সাবেরা ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে। তিনি সালাউদ্দীনের যে নদী মরুপথে সিনেমাতেও তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম তাকে এ দেশ তোমার আমার এ কাজ করার আমন্ত্রণ পাওয়ার পর তিনি এ ছবির নামসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। ১৯৬০ সালে রূপালী জগতে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কখনো আসেনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সঙ্গম নির্মাণ করেন (উর্দু ভাষার ছবি)। তারপরের বছর তার প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা মুক্তি দেন। জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার-ই বিখ্যাত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়া চলচ্চিত্রে। তিনি ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়ার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয়। এ চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন। উল্লেখযোগ্য কাজউপন্যাস : তার পথম উপন্যাস শেষ বিকেলের মেয়ে ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়। হাজার বছর ধরে (১৯৬৪)। আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে রচিত আখ্যান যা  ২০০৫ চলচ্চিত্ররূপ নেয়। আরেক ফাল্গুন ১৯৬৯ বায়ান্নর রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত। বরফ গলা নদী (১৯৬৯) অর্থনৈতিক কারণে বিপর্যস্ত ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত পরিবারের অসহায়ত্ব গাঁথা নিয়েই এটি রচিত। আর কত দিন (১৯৭০) সালে অবরুদ্ধ ও পদদলিত মানবাত্নার আন্তর্জাতিক রূপ এবং সংগ্রাম ও স্বপ্নের-ই আত্নকথা এটি। এছাড়া অন্যান্য রচনাগুলো হলো সূর্যগ্রহণ, তৃষ্ণা, একুশে ফেব্রুয়ারি, কয়েকটি মৃত্যু।চলচ্চিত্র : জহির রায়হান পরিচালিত চলচ্চিত্রসমূহ হচ্ছে- কখনো আসেনি (১৯৬১), সোনার কাজল (১৯৬২) (যৌথভাবে), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), সঙ্গম (১৯৬৪), বাহানা (১৯৬৫), আনোয়ারা (১৯৬৭), বেহুলা (১৯৬৬), জ্বলতে সূরযকে নীচে, জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), স্টপ জেনোসাইড  (১৯৭১), এ স্টেট ইজ বর্ন (১৯৭১), লেট দেয়ার বি লাইট (অসমাপ্ত) (১৯৭০)।পুরস্কারসৃষ্টিশীল এ মানুষটি তার সৃষ্টকর্মের জন্য অনেক পুরস্কার-ই পেয়েছেন। যেমন- আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ১৯৬৪, (হাজার বছর ধরে)। নিগার পুরস্কার (কাঁচের দেয়াল) চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে এ পুরস্কার পান। বাংলা একাডেমী পুরস্কার ১৯৭১ (উপন্যাসের জন্য মরণোত্তর)। একুশে পদক ১৯৭৭ (চলচ্চিত্রের জন্য মরণোত্তর)। স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ১৯৯২ সাহিত্যের জন্য মরণোত্তর পুরস্কার পান এ মানুষটি। জহিরের বিদায়বেলা জহির রায়হান দেশ স্বাধীন হবার পর তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে শুরু করেন। যিনি স্বাধীনতার ঠিক আগমুহূর্তে পাকিস্তানি আর্মির এদেশীয় দোসর আল বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন। জহির রায়হান ভাইয়ের সন্ধানে মিরপুরে যান এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। মিরপুর ছিল ঢাকা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত বিহারী অধ্যুষিত এলাকা। এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, সেদিন বিহারীরা ও ছদ্মবেশী পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশীদের ওপর গুলি চালালে তিনি নিহত হোন।

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ আগস্ট ২০১৪/শান্ত