উদ্যোক্তা/ই-কমার্স

মানুষের সেবা করতেই দেশে এসেছি: ইভ

বিখ্যাত মার্কিন অর্থনীতি বিষয়ক ম্যাগাজিন ফোর্বস। এতে ২০২০ সালের অনূর্ধ্ব-৩০ ক্যাটাগরিতে সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের ‘আমাল ফাউন্ডেশন' এর প্রতিষ্ঠাতা ইশরাত করিম ইভ।

বৃহস্পতিবার (২ এপ্রিল) এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে নির্বাচিত ৩০০ তরুণ উদ্যোক্তাদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন তিনি। এমন সফল মানুষটির সঙ্গে কথা বলেছেন কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত।

সীমান্ত: কেমন অছেন, কীভাবে কাটছে করোনার দিনগুলো?

ইশরাত করিম ইভ: ভালো আছি। তবে, নিজে যতই ভালো থাকি, আশেপাশের মানুষগুলোকে নিয়ে মনের অজান্তেই ভাবি। আমি চাই, খুব শীঘ্রই এই বন্দিজীবন কেটে যাক। আবার প্রাণ ফিরে পাক প্রিয় দেশ আর দেশের মানুষ।

সীমান্ত: বগুড়া শহরে কাটানো শৈশবের স্মৃতি যদি বলতেন।

ইশরাত করিম ইভ: ছোটবেলায় খুব লাজুক ছিলাম। বলতে পারেন মফস্বলের মেয়েরা যেমন হয়। বাবা-মা চোখে চোখে রেখেই বড় করেছেন। তবে ছোটবেলা থেকে মানুষকে সাহায্য করার অন্যরকম বৈশিষ্ট্য ছিল আমার। বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী থাকার সময় একদিনের স্মৃতি ভাসে। এক লোক আমাদের বাসায় ভিক্ষা নিতে এলে, ভিক্ষা দেওয়ার পর কথা বলে এত খারাপ লাগল, ডাইনিং রুমে এসে খেতে দিয়েছিলাম। সেগুলো এখনো স্মৃতিতে ভাসে।

সীমান্ত: জানি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন যুক্ত ছিলেন নানা সংগঠনের সঙ্গে। কিন্তু কখন থেকে মানুষের সেবা করবেন বলে মনস্থির করলেন?

ইশরাত করিম ইভ: ২০১০ সাল, তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী থাকাকালীন বন্ধুদের সঙ্গে অলস বিকেলে বসে আছি টিএসসিতে। এক ছোট্ট শিশু ফুল বিক্রি করতে গেছে এক ভদ্র লোকের কাছে। তিনি ফুল তো নেননি বরং শিশুটাকে লাথি মারলেন। পথশিশুরা যে এই সমাজে মানুষই নয়, সমাজ সেই সত্যটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। এই মানুষগুলোর ভাগ্য বদলাতে দেশে এসেছি, কাজ করছি। বলতে পারেন তখন থেকেই কিছু করার আশায় থেকে আমাল ফাউন্ডেশন গড়ে তোলা।

সীমান্ত: ২০১৪ সালে বৃত্তি নিয়ে চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে। স্বাভাবিকভাবে এমন সুযোগ পেলে অনেকেই দেশে আসতে চান না। আপনি কেন আসলেন?

ইশরাত করিম ইভ: আমি কলোরাডো ইউনিভার্সিটিতে ‘সামাজিক ব্যবসা’ নিয়ে মাস্টার্স করেছি। এখানেই অনেক কিছু শিখি। সেসময় লেখাপড়ার পাশাপাশি পার্ট টাইম চাকরি করেছি বিশ্বখ্যাত দাতব্য সংস্থা ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’-এ। তখনই ভাবি বাংলাদেশেও কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার এ কাজগুলো সেখান থেকেই শেখা। দেশে এসেই ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করি ‘আমাল ফাউন্ডেশন’।

সীমান্ত: উন্নত জীবন ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন ছেড়ে দেশে ফেরত এসেছেন সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের জন্য কাজ করতে। পরিবার থেকে কতটুকু সমর্থন পেয়েছেন?

ইশরাত করিম ইভ: আমার পরিবারের সহযোগিতা ছিল ভীষণ রকমের। আমার ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবসময় আমাকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। প্রথমদিকে অনেকে যখন বলত, চাকরি-বাকরি বাদ দিয়ে মেয়ে কী করছে এসব? সেসময় আমার পরিবার আমার পাশে ছিলেন, আজও তেমনিভাবে ছায়া হয়ে আছেন। আমি আমার পরিবারের সবার কাছে কৃতজ্ঞ।

সীমান্ত: আমাল ফাউন্ডেশনের শুরুর গল্পটা শুনতে চাই?

ইশরাত করিম ইভ: আমেরিকায় চাকরি করার বদৌলতে বেশ কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। জমানো সেই টাকা দিয়েই আমরা প্রথম প্রজেক্ট করেছিলাম। ঢাকাস্থ মিরপুরের বস্তিতে আমরা সে প্রজেক্টে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য, বাল্যবিবাহ রোধ, তারা কীভাবে সাবলম্বী হতে পারে, সেটা নিয়ে প্রজেক্টটা করেছিলাম। বলতে গেলে শুরুর দিকের গল্পগুলো অনেক বেশিই চ্যালিঞ্জিং ছিল। তবে আনন্দের কথা, সেসময় আমাদের সাথে যেসব ভলান্টিয়ার ছিলেন, তারা আজও আমাদের সাথে রয়েই গেছেন, আমালের সাথে কাজ করছেন। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করি ‘আমাল ফাউন্ডেশন'।

সীমান্ত: আমাল ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।

ইশরাত করিম ইভ: আমরা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ও শহরের গরীব, অসহায় মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষাগত উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, দুর্যোগে-দুর্ভোগে কাজ করে থাকি। বস্তির কিশোরী-তরুণীদের শেখাই মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার গুরুত্ব, তাদের যৌন নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সামাজিক-মানসিক কাউন্সিলিং করি। চরের মেয়েদের স্বাবলম্বী করে তোলার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ রোধ ও যৌতুকের অভিশাপের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছি।

সীমান্ত: সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে কাজ করছেন অনেক দিন যাবত, তাদের সবচেয়ে বড় সংকট কী?

ইশরাত করিম ইভ: আমরা অনেকেই সুবিধাবঞ্চিতদের সহযোগিতা করি। কিন্তু এ সহযোগিতা তখনই কাজে আসবে, যখন ওই মানুষটি নিজে থেকে স্বাবলম্বী হবে। তখন অন্য কারো দিকে চেয়ে থাকতে হবে না। আমার মনে হয়, অন্যরা এটি চিন্তা করে না। কিন্তু আমরা এ বিষয়টি থেকে একটু ভিন্নতর। এজন্য শিক্ষা, স্বাবলম্বী করার প্রজেক্টের মাধ্যমে কাজগুলো করে যাচ্ছি। যেমন ধরুন, কাউকে সেলাই মেশিন কিনে দিচ্ছি, কাউকে রিকশা, কাউকে দোকান করে দিচ্ছি, কাউকে গবাদি পশুসহ এককালীন কিছু।

সীমান্ত: মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি সীমাবদ্ধতার মধ্যে পড়তে হয়েছে কখন?

ইশরাত করিম ইভ: সীমাবদ্ধতার অনেক গল্প আছে। আসলে কোনটা ছেড়ে কোনটা যে বলি। আমার মনে আছে, শুরুর দিকে নদীর চরে আমরা নারীদের স্বাবলম্বী করতে, বাল্যবিবাহ রোধসহ শিক্ষা কার্যক্রমে উব্ধুদ্ধ করতে বেশ কিছু প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিলাম। কিন্তু গ্রামের বয়স্ক আর মাতুব্বররা এটাতে বাধা দিলেন। তারা চাইলেন না ওই এলাকার নারীদের সাথে আমরা কাজ করি, কিংবা কথা বলি। পরে না চাইলেও আমাদের ওই প্রজেক্ট বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। কিন্তু আমরা এলাকার বেশ কিছু যুবসংঘের সাথে কথা বলে এমনকি বয়স্ক-মাতুব্বরদের আমাদের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে প্রজেক্টটা পুনরায় শুরু করেছিলাম।

সীমান্ত: ৪০০ স্বেচ্ছাসেবকের লিডার ইশরাত করিম ইভ, এটা যখন মনে পড়ে নিজের কাজের প্রতি দায়িত্ববোধ নিয়ে কী ভাবেন?

ইশরাত করিম ইভ: সত্যিই তাই। স্বেচ্ছাসেবকরা না থাকলে আমাল ফাউন্ডেশনের অস্তিত্ব চিন্তা করা যায় না। আমি কোনো কাজের পরিকল্পনা করলে শুধু তাদের জানাই, কাজটি নিমিষেই সম্পন্ন হয়ে যায়। আমার প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও স্নেহ আমাকে সাহস জোগায়।

সীমান্ত: কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ আপনি ফোর্বসের তালিকায়। আপনার অনুভূতি নিশ্চয়ই ভালো বলার অপেক্ষা রাখে না?

ইশরাত করিম ইভ: ফোর্বস ম্যাগাজিনে স্থান পাওয়া আমার জন্য সত্যিই অনেক গর্বের বিষয়। সবার সহযোগিতা না থাকলে এমন অর্জন কখনই সম্ভব হতো না। আমি আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সংগঠন, সহযোগী সবাইকে ধন্যবাদ দিতে চাই, এ আনন্দ আসলে আমাদের সবার। আর এ অর্জন আমি আমাল ফাউন্ডেশনের ভলান্টিয়ার ও পার্টনারদের উৎসর্গ করতে চাই। ভলান্টিয়ারদের কাজই এ পুরস্কার এনে দিতে সাহায্য করেছে।

সীমান্ত: সবাই সফলতার গল্পটা শুনতে ভালোবাসেন, ব্যর্থতার গল্পগুলো আড়ালেই থেকে যায়। যদি সফলতার পেছনের গল্পগুলো বলতেন।

ইশরাত করিম ইভ: আমালের পথচলায় অনেক বাধা-বিপত্তি এসেছে। আবার একজন নারী হয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে কাজ করতে গিয়ে হাজারো বাধার সম্মুখীন হয়েছি। আসলে সেগুলো আমাদের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে। বরং নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। এসব না বলাই থেকে যাক, আমরা এগোতে চাই, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ চাই।

সীমান্ত: ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান?

ইশরাত করিম ইভ: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমরা নতুন প্রজন্ম তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চাই। দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদাগুলো যেন যথাযথভাবে পূরণ হয়, এটাই প্রত্যাশা করি।

সীমান্ত: করোনা নিয়ে আতঙ্কিত গোটা বিশ্ব, আমাদের দেশেও দিনে দিনে আতঙ্ক বেড়েই চলছে। নিজেকে কীভাবে সুরক্ষিত রাখছেন এবং সবার উদ্দেশে যদি কিছু বলতেন।

ইশরাত করিম ইভ: আমরা দুস্থদের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছি। ঢাকার রাস্তায় অসহায়, অবলা প্রাণীদের খাবার দিচ্ছি। এছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় হাত ধোয়ার জন্য বেসিন ও পানির ট্যাপ বসিয়েছি, সেখানে হ্যান্ড ওয়াশ রেখেছি, যাতে পথচারীরা করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমরা করোনা মোকাবিলা করতে পারবো বলে আশা করছি।

নিজেকে যতটুকু সম্ভব সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করছি। সবার উদ্দেশে বলবো, ঘরে থাকুন, দেশকে ভালো রাখুন। সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে সতর্ক থাকলে আমরা এই পরিস্থিতি অতি দ্রুত মোকাবিলা করতে পারব।

সীমান্ত: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, নিরাপদে থাকবেন।

ইশরাত করিম ইভ: আপনাকে এবং রাইজিংবিডিকে অনেক ধন্যবাদ। আপনারাও নিরাপদে থাকবেন।

 

ঢাকা/হাকিম মাহি