উদ্যোক্তা/ই-কমার্স

‘বন্ধুরা যখন বিসিএসে ব্যস্ত, আমি তখন উদ্যোক্তা’

উদ্যোক্তা হতে গেলে জেদ, ইচ্ছা শক্তি, একাগ্রতার পাশাপাশি স্রোতের বিপরীতে গা ভাসানোর সংগ্রাম করার সাহস থাকা চাই। কেউ এ সংগ্রামে টিকে থাকতে পারে, কেউ পারে না। যিনি টিকে থাকতে পারেন, তিনিই সফলতার আলো দেখেন, আবার তিনিই হয়ে ওঠেন সফলতার উদাহরণ। 

এমনই এক সফল উদাহরণের নাম শেফাতুন নাহার মিম। রাজশাহী জেলার মেয়ে মিম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। পড়াশোনা শেষ করে গৎবাঁধা নিয়মে অন্যদের মতো চাকরির দিকে গা ভাসায়নি মিম। সবাই যখন চাকরির জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন, একই সময়ে মিম হয়ে উঠেছেন একজন পুরোদস্তুর উদ্যোক্তা।

মিমের উদ্যোগের নাম ব্যঞ্জন। রাজশাহীতে দেশীয় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী হোমমেড খাবার নিয়ে কাজ করছে ব্যঞ্জন। মিম বলেন, ‘অনার্স তৃতীয় বর্ষে যখন সবাই বিসিএস কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছে, আমি তখন যুব উন্নয়ন, বিসিকে ট্রেনিং করেছি। তখন টুকটাক উদ্যোক্তা জীবনও শুরু করেছি। নিজে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করবো, কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবো, এটাই স্বপ্ন দেখতাম।’

৫/১০টা চাকরি খুব অপছন্দের ছিল তার। তাই স্বাধীনভাবে নিজেই কিছু করতে হবে সেই ভাবনা থেকই মূলত মিমের ব্যঞ্জনের যাত্রা। ‘ব্যঞ্জন’ শব্দটির অর্থ হলো রান্না করা তরকারি। এটি আসলে একটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। 

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার, অর্থাৎ বাংলা খাবার এখনকার তরুণ প্রজন্মের কাছে অনেকটা উপেক্ষিত। ফাস্টফুডের ভিড়ে আমাদের আপন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করানোর একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার নাম ব্যঞ্জন। বিভিন্ন রকমের নাড়ু, মোয়া, পিঠা, পায়েস, ফিরনি এগুলোই ব্যঞ্জনের পণ্য। ব্যঞ্জনের মাধ্যমে এই তরুণ উদ্যোক্তা মিম দেশি খাবারের প্রসার ঘটাতে কাজ করে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে ব্যঞ্জন অনলাইনে ও অফলাইনে বেশ সাড়া ফেলেছে। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে তাদের মূল কার্যক্রম চলছে। বিভিন্ন সময় তারা বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে।

উদ্যোক্তা জীবনের প্রথম আয়ের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে শেফাতুন নাহার মিম বলেন, ‘সেই এক দারুণ অভিজ্ঞতা! ব্যঞ্জনের প্রথম অর্ডার এসেছিল আমাদের পেজের মাধ্যমে। একজন আপু ১০ পিস পাটিসাপটা পিঠা অর্ডার করেছিলেন। আমি ভীষণ আনন্দিত হই, একজন অপরিচিত মানুষ আমাদের উপর ভরসা করতে পেরেছেন। খাবার বিজনেস আমি মনে করি অন্যসব বিজনেসের চেয়ে বেশি দায়িত্বশীল থাকতে হয়। কারণ, এটা খুব সেনসিটিভ বিষয়। আবার খুব নার্ভাস লাগছিল কারণ তাকে সন্তুষ্ট করতে পারবো কি না, খাবারটা টাইমলি ডেলিভারি করতে পারবো কি না, যেহেতু আমরা হোম ডেলিভারি করি।’ 

‘যাইহোক ২৫০ টাকার অর্ডার ছিল। আপু পরে যখন জানালেন যে পিঠা উনার খুব ভালো লেগেছে, তখন সেই ২৫০ টাকা হাতে নিয়ে মনে হচ্ছিল আমি বেশ উপার্জন করতে পেরেছি। কেননা আমার কাস্টমার সন্তুষ্ট। কাস্টমারের সন্তুষ্টি হচ্ছে বড় অর্জন।’

এখন প্রতিনিয়তই কাজের চাপ থাকে ব্যঞ্জনে। এ থেকে আয়-উপার্জনও বেশ ভালোই হচ্ছে মিমের। উদ্যোক্তা হিসেবে দক্ষতা উন্নয়নের জন্য মিম ইএসডিপি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি রাজশাহী জেলার ইএসডিপির তৃতীয় ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী। উদ্যোক্তা হিসেবে পথচলায় ইএসডিপি যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে নারীদের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স (উই) থেকে বেশ অনুপ্রেরণা পান এই নারী উদ্যোক্তা। 

উই সম্পর্কে মিম জানান, উই থেকেও তার বেশ ভালো কিছু অর্ডার এসেছে। ব্যবসা রিলেটেড আলোচনা হয় উই গ্রুপে। পোস্টগুলো পড়ে অনেক কিছু শেখা যায়। গ্রুপটি নারী উদ্যোক্তাদের শেখার জন্য অত্যন্ত ভালো একটি  প্ল্যাটফর্ম।

এ ধরনের উদ্যোগ নিতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতা স্বীকার হতে হচ্ছে কি না জানতে চাইলে মিম বলেন, ‘উদ্যোক্তা হিসেবে সামাজিক, পারিবারিক বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতা থাকে। আসলে আমাদের দেশে চাকরি ওপর নির্ভরতা বেশি। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গী বদলাচ্ছে।’

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সহজে পণ্য রপ্তানি কিংবা সরকারিভাবে ই- কর্মাসের মাধ্যমে সারা দেশে পণ্য বিক্রয়ের ব্যবস্থা থাকলে খুব উপকার হবে বলে মিম মনে করেন। 

তিলের নাড়ু ব্যঞ্জনের সবচেয়ে স্পেশাল আইটেম। মজাদার ও পুষ্টিকর একটি স্ন্যাকস তিলের নাড়ু। তিল বেছে পরিষ্কার করে গুড়ের সিরা তৈরি করা হয়। তার মধ্যে ভাজা তিল ছেড়ে দিয়ে গরম গরম অবস্থায় বানাতে হয় মজাদার তিলের নাড়ু। চিনির বদলে গুড় আর শস্যবীজ তিল দিয়ে বানানো নাড়ু অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। 

নিজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে শুকনো সংরক্ষণশীল জাতীয় খাবার (নাড়ু, শুকনো পিঠা, আচার, পাপড়, শুটকি) রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করার ইচ্ছা মিমের। মিম স্বপ্ন দেখেন একদিন ব্যঞ্জনের খাবার ছড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও দেশি খাবার পৌঁছে যাবে।

ঢাকা/মাহি