উদ্যোক্তা/ই-কমার্স

বাচ্চাগুলোর প্রয়োজন সাহায্য নয়, সহযোগিতা 

বয়স আর কতই হবে! ৮-১৫ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী তারা। এই বয়সেই করছে কাজের সন্ধান। কারণ একটাই, খেয়ে-পরে বেঁচে থেকে পড়াশোনা করা। কেননা, তাদের কারো পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নেই। আবার কারো পরিবারে প্রয়োজনের তুলনায় আছে অল্প উপার্জনকারী ব্যক্তি। পড়াশোনার খরচ তো দূরের কথা অনেক সময় দু’বেলা ঠিকঠাক খাওয়াও জোটে না।

বলছি কিছু শিশু ও কিশোরীর কথা। যে বয়সে তাদের হেসে খেলে বেড়াবার কথা, সেই বয়সেই তাদের নামের আগে যুক্ত হয়েছে সুবিধাবঞ্চিত শিশু। এই বয়সেই তাদের চিন্তা করতে হয় জীবন-জীবিকার। সমাজ-সংসারের যাতাকলে প্রতিনিয়িত পিষ্ট হচ্ছে তারা। কারো বাবা নেই, কারো মা নেই। কারো আবার কেউ থেকেও নেই।

বগুড়া জেলার সেউজগাড়ি, এলাকার একটি ছোট্ট ঘর। যেখানে মেলা বসে কিছু কিশোরীর। প্রায়ই তারা এই ছোট্ট ঘরটিতে একত্র হয়। আর এই একত্র হওয়ার ব্যবস্থাটুকু করেছে ‘আলোর দিশারি’ নামে একটি সংগঠন। যাদের মূল উদ্দেশ্য বাচ্চাদের স্কুলমুখী করা। মূলত তারা বাচ্চাদের পড়াশোনায় সহযোগিতা করে।

করোনাকালীন সময়ে ৪র্থ থেকে ৭ম শ্রেণির প্রায় ২০ জন মেয়েকে তারা হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বাহির থেকে কিছু প্রশিক্ষকও আসছেন তাদের সেলাই শেখাতে। কিশোরীরা সুই-সুতোয় বুনে চলেছে তাদের স্বপ্ন। ভীষণ আগ্রহ সহকারে কাজ শিখছে। তাদের নিজেদেরও ইচ্ছে হাতের কাজ শিখে স্বাবলম্বী হওয়ার। তাই সবাই বেশ মনযোগী হয়ে কাজ শিখছে। যদিও এখনো তারা তেমন কোনো ক্রেতা পায়নি। সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা ও বাইরের হাতে গোনা দুই একজন মানুষ তাদের হাতে তৈরি পণ্য কিনছেন।

তাদের হাতের কাজের মধ্যে রয়েছে সুতা দিয়ে নকশা করা বিভিন্ন ইয়োক, রুমাল, চটের ওপরে উলের সুতা দিয়ে নকশা করা ম্যাট, পট হোল্ডার (যাকে আমরা চলিত ভাষায় লুছনী বলে থাকি)। একইসঙ্গে কেউ জামা, কুর্তি বা পাঞ্জাবিতে সুতার কাজ করে নিতে চাইলে সেটাও তারা করে দিতে পারে। এছাড়াও নিজ উদ্যোগে তাদের আরও বেশ কিছু কাজ শেখাচ্ছেন অনেকেই। যার মধ্যে রয়েছে, হাতে তৈরি গহনা, দর্জির কাজ, মেহেদী ডিজাইনিং ইত্যাদি।

বেশ কয়েকজন কিশোরীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা সবাই হাতের কাজ শিখতে আগ্রহী। পড়ালেখা সচল রাখতে তারা চায় স্বাবলম্বী হতে। যেন নিজের পড়ালেখার খরচটা নিজে চালাতে পারে। হাতের কাজ করলে অবসর সময়ে তা পড়াশোনার পাশাপাশিই করা যায়। সঠিক শিক্ষা অর্জন ও নিজের স্বপ্ন পূরণ করার প্রত্যয় নিয়েছে ছোট্ট শিশুরা।  

তেমনই একজন কিশোরী শান্তি। সে ৭ম শ্রেণির ছাত্রী। ডিজাইনিংয়ে ভীষণ পটু। সুযোগ পেলেই সে মেহেদীতে মনকাড়া ডিজাইনে রাঙিয়ে দেয় অনেকের হাত। তার মা চান অল্প বয়সেই বিয়ে দিতে। কিন্তু সে বিয়ে না করে ডিজাইনিং নিয়ে কাজ করতে চায়।

শামীমা স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে সে একজন পাইলট হবে। তাই সে চায় তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে। সরকারি স্কুলে হলেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে গেলে প্রয়োজন অর্থের। সেই অর্থ উপার্জনের জন্য সুযোগ পেয়ে হাতের কাজ শিখছে শামীমা। লক্ষ্য নিজের পড়াশোনার খরচটুকু অন্তত উপার্জন করা।

শান্তি, শামীমার মতো রিয়া, মৌসুমি, মনি, ফুল, রাজিয়া, সুমাইয়াসহ আরও অনেকেই রয়েছে এই তালিকায়। ওরা বড় হয়ে নয়, এখনি কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের দায়িত্ব নিতে চায়। অর্থের অভাবে তাদের বাবা-মায়েরা চান অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে। কিন্তু অল্প বয়সী শিশুরা চায় স্বাবলম্বী হতে ও বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াতে। ওদের প্রত্যেকের মাঝেই রয়েছে মেধা ও সম্ভাবনা।

বাচ্চাগুলোর প্রয়োজন সাহায্য নয়, সহযোগিতা। শুধু একটু যত্ন, ভালোবাসা ও সুযোগ পেলে এই বাচ্চাগুলোও তাক লাগিয়ে দিতে পারে বিশ্বকে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, ক্ল্যাজ ফুড।

ঢাকা/সিনথিয়া/মাহি