উদ্যোক্তা/ই-কমার্স

মালয়েশিয়ায় শিক্ষার্থী থেকে উদ্যোক্তা তৃষা

‘সময়টি ছিল ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস। আমার মায়ের হাত ধরে মালয়েশিয়ার মাটিতে আমি প্রথমবার পা রাখলাম। ঠিক ওই মুহূর্ত থেকেই জীবনের একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়ে যায়।’ এই কথাগুলো বলেছিলেন মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি প্রবাসী ফারজানা আলম তৃষা।

বাংলাদেশে তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির (আইইউবি) শিক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু তার ইচ্ছা ছিল দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করার। তার ছোট ভাই তার আগে থেকেই মালয়েশিয়াতে পড়াশোনা করতো, তাই তিনি নিজেও সিদ্ধান্ত নিলেন মালয়েশিয়াতে শিক্ষাজীবনের নতুন একটি অধ্যায় শুরু করবেন।

তৃষা বলেন, মালয়েশিয়াতে যাওয়ার সময় আমি কিছুই বুঝতে পারিনি যে, আমি আমার মা-বাবা থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমি ছুটি কাটাতে যাচ্ছি। কারণ, আমার ছোট ভাই আগে থেকেই সেখানে পড়ালেখা করছিল। বাংলাদেশ থেকে আমি গিয়ে তার বাসাতেই উঠি ও দুই ভাই-বোন মিলে একটি মজার জীবন কাটাতে শুরু করি।

প্রায় ছয় মাস পর থেকে আমি আমার মাকে খুব মনে করতে থাকি। মা ছাড়া কিছুই ভালো লাগতো না। আমি অনেক আদুরে মেয়ে ছিলাম, তাই প্রবাসে আমার ভাই থাকা সত্ত্বেও আমি আমার মাকে খুব বেশি মনে করতাম। আমার জন্য প্রবাসের জীবন খুব কঠিন হয়ে উঠছিল। সবরকম কাজ আমার নিজেরই করা লাগতো, যা আমি মায়ের কাছে থাকা অবস্থায় কোনো দিনও করিনি। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি যে, এইগুলো জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। আজ আমি আমার সবরকম কাজ নিজেরটা নিজেই করি বরং মাঝে মাঝে আমার ভাইয়ের কাজও আমি করে দেই।

এখানে আমি ইউসিএসআই (UCSI) বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ইন মার্কেটিং (B.B.A in marketing) এ ভর্তি হই। এখানকার পড়ালেখার মান অনেক উন্নত। আমি একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলাম, তাই প্রথমদিকে আমার বন্ধুবান্ধব ছিল না, এমনকি বন্ধুত্ব করতেও আমার বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতো। কিন্তু এখন ব্যাপারটা উল্টো, আমার এখন সারাটা দিনই কেটে যায় বন্ধুদের সঙ্গে। 

আমি ঘোরাফেরা খুবই পছন্দ করি। মালয়েশিয়ায় ঘোরাফেরার জন্য অনেক স্থান রয়েছে। তার মধ্যে আমার দৃষ্টিতে যেগুলো খুব ভালো লাগে, সেগুলো হচ্ছে সুরিয়া কেএলসিসি (PETRONAS twin tower), গান্টিং আইল্যান্ড, ক্যামেরুন আইল্যান্ড, লাংকোয়ি বিচ এগুলো অন্যতম। এখানে সাধারণত দুইটি ঋতু। মজার ব্যাপার হলো যে দুইটি ঋতুতেই বৃষ্টি হয়। ৬ মাস হাল্কা বৃষ্টি, বাকি ৬ মাস ভারী বর্ষণ হয়।

আমি খুব বেশি ক্লাবিং ও খাওয়া-দাওয়া করতাম। বলতে গেলে এমন কিছু সময় ছিল, যখন আমি সারাদিনের বেশিরভাগ সময়ই ক্লাবে কাটাতাম। এখানকার যুক ক্লাব আমার খুব পছন্দের। আর খাওয়ার মধ্যে নাসি গোরেং ও চিকেন গোরেং অন্যতম। 

বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় জীবনের কিছু কঠিন অভিজ্ঞতা ছিল আমার। আমি কিছু ভুল মানুষের প্রলোভনে ও আমার নিজেরও কিছু ভুলের কারণে আমার জীবনটা বিষাদময় হয়ে উঠছিল। জীবনে আসলেই এমন কিছু সময় ও বয়স থাকে, যখন আমরা মনের ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় ভুল করে ফেলি। আমি ভুল মানুষের দিকে ঠিকই এগিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু আমার জন্য যে অথবা যারা ঠিক ছিল, তা আমি ওই সময়ে ভেবে দেখিনি। তাহলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো।

আমার জীবনের বিষাদময় সময়কে আমার কাছে এখন আর্শিবাদের মতো মনে হয়। কারণ সেই সময়ের কারণেই আমি আজ একজন উদ্যোক্তা হতে পেরেছি। আমি ও আমার বোন মিলে লেডিস গুডস (মেয়েদের সামগ্রী) নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। আমি মালয়েশিয়া থেকে পরিচালনা করি, আমার বোন বাংলাদেশে থেকে আমাকে সহযোগিতা করে।

আমরা সাধারণত মালয়েশিয়া, চায়না, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে লেডিস গুডসগুলো সংগ্রহ করি ও অনলাইনে তুলনামূলকভাবে অনেক কম মূল্যে বিক্রি করি। আমার কোম্পানিটি অনেক কম সময়ে অনেক ভালো সাড়া পায়। বাংলাদেশে চিত্রশিল্পী, মডেল ও অনেক শিল্পপতিরা আমার ক্রেতা। পণ্যগুলো সাধারণত উচ্চ পরিসর থেকে মধ্যম পরিসরের মূল্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমার লক্ষ্য হচ্ছে উন্নত মানের ব্র্যান্ডের পণ্যগুলো আমার নিজ দেশের মানুষের কাছে তাদের সাধ্যের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া।

আমার পরিবার দেশে থাকার কারণে তাদের কথা ও তাদের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো আমি খুব মনে করি। কিন্তু ঠিক তেমনিই দেশে আসলেও মালয়েশিয়ার কথা আমার খুব মনে পড়ে। কারণ, মালয়েশিয়া আমার জীবনটাকে বদলাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কথায় আছে না, (failure is the piller of success), এই উক্তিটি আমি মালয়েশিয়া থেকেই বুঝতে পারি ও আজ শিক্ষার্থী থেকে একজন উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে এই দেশটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

মালয়েশিয়ার পড়ালেখা ও জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত। তাই আমি এতটুকু বলতে পারি, পড়ালেখা করে কর্মজীবন শুরু করতে চাইলে এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে বসবাস করতে চাইলে মালয়েশিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্তটি অন্যতম। কারণ এখানে আপনি জীবনটাকে খুব সহজেই উপভোগ করতে পারবেন ও পাশাপাশি জীবনের একটি সুন্দর দিক-নির্দেশনা খুব সহজেই দিতে পারবেন।