উদ্যোক্তা/ই-কমার্স

জলরঙের মসলিনে মাতবেন নারীরা 

নাহিদ সুলতানা, জন্ম ও বেড়ে ওঠা পিরোজপুর শহরে। আদি বাড়ি বাগেরহাট। বাবা-মা দুজনেই শিক্ষক। তাদের প্রথম ও একমাত্র সন্তান তিনি। মেয়ে হলেও পরিবার থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা পেয়েছেন নাহিদ। তাই উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরি ও টিউশন করেছেন। নিজের পড়ালেখার খরচ নিজে চালিয়েছেন তিনি। হিসাববিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স করার পর কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ে ইন্টারমিডিয়েট কোর্স শেষ করেছেন তিনি।

২০০০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু করেন নাহিদ সুলতানা। এডুকো (এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন) নামে একটা ইন্টারন্যাশনাল এনজিওতে ম্যানেজার অ্যাডমিন অ্যান্ড ফাইানান্স হিসাবে ১৪ বছর চাকরি করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে নিজের উদ্যোগকে সময় দেওয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি উদ্যোক্তা হিসাবে নতুন পথচলা শুরু করেন তিনি।

বর্তমানে ফেসবুক পেজ ‘জলরং’-এর মাধ্যমে হ্যান্ডপেইন্ট মসলিন শাড়ি, টাঙ্গাইল হাফ সিল্ক ও সুতি শাড়ি, হ্যান্ডপেইন্টেড মসলিন ও সুতি থ্রিপিস, হ্যান্ডপেইন্টেড ফতুয়া ও কুর্তি নিয়ে কাজ করছেন তিনি। এছাড়াও মসলিন স্কার্ফ ও পোশাকের সব শাখাকেই হ্যান্ডপেইন্টের রঙে রাঙাতে ইচ্ছা পোষণ করেন নাহিদ।

তিনি বলেন, ‘‘২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে চাকরির পাশাপাশি আমার উদ্যোগ জলরঙের যাত্রা শুরু হয়। ২০১৯ সালের শুরুর দিক থেকেই চাকরির পাশাপাশি জলরঙকে চালানো আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়ে। দিনে ২/৩ ঘণ্টা ঘুমিয়ে সব দিক সামাল দিতে পারছিলাম না। অনেক চিন্তা ভাবনার পরে চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কারণ আমার সঙ্গে জলরঙে যারা কাজ করতেন, তাদের রুটিরুজির দায়িত্বটা আমার উপরে বর্তায়। আর ব্যবসা যত ছোট হোক, সেটা আমার নিজের। এপ্রিল ২০১৯ থেকে শুরু হলো নতুন জীবন।

শুরুতে রাজশাহী সিল্ক ও মসলিন শাড়িতে হ্যান্ডপেইন্ট করার পরিকল্পনা করি। পরে কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতেও কাজ করা শুরু করি। ধীরে ধীরে আর্টিস্টের সংখ্যা বাড়ে। শাড়ির পাশাপাশি একে একে মসলিন ও সুতি থ্রিপিস, ওড়না, ফতুয়া প্রোডাক্ট লাইনে যোগ হয়। এই মুহূর্তে ৬ জন আর্টিস্ট জলরঙের সঙ্গে কাজ করেন। 

আমার পড়াশুনার ব্যাকগ্রাউন্ড যেহেতু একেবারে ভিন্ন, তাই ২০১৯ সালে চাকরি ছাড়ার পরে ধীরে ধীরে উদ্যোগ সম্পর্কিত জায়গাগুলোতে নিজের দক্ষতা বাড়িয়েছি। যেমন- ফ্যাশন ও জুয়েলারি ডিজাইন এবং বিজনেস ম্যানেজমেন্টের উপর ডিপ্লোমা করেছি। ই-কমার্স ও ফেসবুক বিজনেস নিয়ে পড়াশুনা করেছি। মোটকথা উদ্যোগ চালানোর জন্য নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলেছি। পাশাপাশি আমার ২০ বছরের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতাও এ ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছে।’’

নাহিদ সুলতানা বলেন, “আমি যখন জলরঙের যাত্রা শুরু করি, তখন এককভাবে হ্যান্ডপেইন্ট নিয়ে তেমন কেউ কাজ করতো না বললেই চলে। যারা করতো তারা কেউই এখন আর কাজ করছেন না। প্রতিবন্ধকতা অনেক এসেছে। যথাসময়ে কাস্টমারের কাছে প্রোডাক্ট পৌঁছে দেওয়া ও প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে কাস্টমার সেটিসফেকশন-এগুলোকে আমি বরাবর গুরুত্ব দিয়ে এসেছি।

আমার উদ্যোগের সফলতা বলতে, মানুষের মনে জলরঙ একটা বিশেষ জায়গা করে নিতে পেরেছে। এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় বা অন্য কোনো জায়গায় মানুষ আমাকে জলরঙের নাহিদ আপা নামে চিনতে পারে। আবার প্রতিষ্ঠানের শাড়ি বা পোশাক দেখলেও মানুষ চিনতে পারে।

আমার মা ও স্বামীসহ আমার পুরো পরিবার আমার সাথে ছিলেন বলেই আমি এত দূর আসতে পেরেছি। এমনকি আমার ৭ বছর বয়সী ছেলেও আমাকে সহযোগিতা করে। এর পাশাপাশি আমার বোনের মেয়ে শায়লা জিন্নাত রুনির সহযোগিতা না থাকলে এত দূর আসা সম্ভব হতো না। এটা মুদ্রার একটা পিঠ। অন্য পিঠে আছেন ই-ক্যাবের (ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) সাবেক প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধেয় রাজীব আহমেদ ভাই এবং তার প্ল্যাটফর্ম ডিজিটাল স্কিলস অব বাংলাদেশ। এখান থেকে ব্যবসার অনেক কিছু শিখেছি। পাশাপাশি উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স গ্রুপে সময় দেওয়ার জন্য আমার পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং ভালো হয়েছে বলে আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। এজন্য নাসিমা আক্তার নিশা আপুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’’

হ্যান্ডপেইন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মসলিনকে আবারো বিশ্বের কাছে পরিচিত করতে চান তিনি। হ্যান্ডপেইন্টের নতুন ফিউশন, প্রোডাক্ট রেঞ্জ ও ডিজাইন নিয়ে এগিয়ে যেতে চান বহুদূর নাহিদ সুলতানা। তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন জলরঙ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে পৌঁছে যাবে। সেই লক্ষ্যে জলরঙের ওয়েবসাইট নিয়েও কাজ করছেন তিনি। করোনার মহামারি থাকা সত্ত্বেও ২০২০ সালে জলরঙের বিক্রি ছিল ১৫,৮৮,৫৮০ টাকা।