উদ্যোক্তা/ই-কমার্স

মেয়ের জন্য বানানো দোলনাই এখন অর্পিতার উদ্যোগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো রেজাল্ট করে এমবিএ শেষ করেও মন কখনো চাকরি করতে সায় দিতো না। হয়তো স্বাধীনচেতা ছিলেন বলেই অন্যের অধীনে কাজ করার ইচ্ছা ছিল না অর্পিতার। তার আগ্রহ ছিল নিজে কিছু করবেন এবং পাশাপাশি অন্যদেরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন।

ছোটবেলা থেকেই অর্পিতা খুব ক্রিয়েটিভ এবং ফ্যাশন সচেতন। সে কারণেই তিনি ২০১৭ সালের শেষ দিকে শুরু করেছিলেন তার হাতে তৈরি গহনার কাজ। 

অর্পিতা বলেন, ‘‘শুরুটা সহজ ছিল না মোটেও। সাপোর্টিভ হ্যান্ড হিসেবে ছিলেন শুধু আমার স্বামী। এক হাতে সংসার, একমাত্র মেয়ে ও শ্বশুর-বাবা সবকিছু সামলিয়ে উদ্যোগটা যখন সফলভাবে চলছিল, এমন সময় সবার জীবনের মতো আমার জীবনেও ধাক্কাটা আসলো। অর্থাৎ শুরু হলো কোভিট-১৯। যেহেতু আমার ব্যবসাটা ছিল গহনা নিয়ে, যেখানে মানুষের দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকা মূখ্য ছিল, সেখানে বিলাসী পণ্য কেনার আশা করাটাই ছিল নিছক বোকামি। তাই আমার উদ্যোগটা থমকে যায়। 

একটা কথা না বললেই নয় ২০১৯ এর অক্টোবর থেকেই আমি ‘উই’র (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) এর নিষ্ক্রিয় সদস্য ছিলাম। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই আমি উইতে একটিভ হওয়ার শুরু করি। এর আগে শুধু আমি উইকে পর্যবেক্ষণ করতাম। উইতে দেখলাম উই ফোকাস করছে দেশীয় পণ্য ও আমাদের হারানো ঐতিহ্যকে। যেহেতু আমার আগের উদ্যোগটা এক প্রকার বন্ধই হয়ে যায়, তখন আমি হতাশ হয়ে পড়ি। সিদ্ধান্ত নেই আবার নতুন করে নিজেকে গোছানোর এবং খুঁজতে শুরু করি আমি কোন কাজটা ভালো পারি। 

কারণ, উই থেকে শিখেছি আমরা যে কাজটা ভালো পারবো, তা নিয়েই কাজ করা উচিত। আমি যেহেতু গিঁটশিল্প ভালো পারি, তাই আমি এটাকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু বাঁধ সাধলো লকডাউন। কারণ লকডাউনের কারণে আমি র’ ম্যাটেরিয়াল কালেক্ট করতে পারছিলাম না। লকডাউন যখন কিছুটা শিথিল হয়, তখন আমি আমার র' ম্যাটেরিয়ালস হাতে পাই।  আমার নতুন উদ্যোগ শুরু করি।’’ 

প্রথমে অর্পিতা প্ল্যান্ট হ্যাংগার, টেবিল ম্যাট, ওয়াল হ্যাংগিং দিয়ে কাজ শুরু করেন। হঠাৎ পাশের বাসায় একটা ছোট দোলনা দেখে অর্পিতার মেয়ে বায়না ধরলো তারও অমন দোলনা চাই। আশেপাশে যখন খুঁজে যখন তিনি দোলনা পেলেন না, তখন অর্পিতা নিজেই দড়ি দিয়ে দোলনা বানিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অবশেষে তিনি পেট হ্যামকের মতো একটা দোলনা বানিয়ে দেন তার মেয়েকে। 

অর্পিতা আরো বলেন, ‘‘দোলনা পেয়ে মেয়ের উচ্ছ্বাস দেখে সেটা ভিডিও করি এবং আমার আনন্দটা উইতে শেয়ার করি। সেদিন থেকে মানুষের এত অনুপ্রেরণা পাই যে, আমি নিজেই এটা নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। অনেক ভেবে আমার উদ্যোগের নাম দিই ‘Knot Art BD’। পরে যখন বুঝতে পারলাম দোলনার প্রতি ভালোবাসা শুধু বাচ্চাদের নয়, বড়দের আগ্রহও কম নয়, তখন থেকেই বড়দের জন্যও দোলনা বানানো শুরু করলাম। 

প্রথম মাসেই আমার লাখ টাকার শুধু দোলনা অর্ডার হয়। এই অর্ডারগুলো কমপ্লিট করার জন্য আমি ২ জন কর্মচারী নিয়োগ করি, যারা এই করোনাকালীন সময়ে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। ২০২০ সালের জুন থেকে শুরু করে আগস্ট, এক মাস ২০ দিনে অনেক কর্ম ব্যস্ততায় কেটেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে আমার শ্বশুর বাবার করোনা পজেটিভ হয়। তারপর আবার আমার উদ্যোগটা দুই মাসের জন্য গতি হারায়। দীর্ঘ ২৭ দিন হসপিটাল থেকে সুস্থ করে আমার শ্বশুর বাবাকে বাসায় ফিরিয়ে আনি। এখন আবার নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু করলাম। 

শেষের দিকের অর্ডারগুলো সব জমে ছিল। আমার বেশিরভাগ কাস্টমার উই থেকে পাওয়া, তারা আমাকে আমার এই দুঃসময়ে অনেক সাপোর্ট করেছিলেন। তারা অর্ডার ক্যান্সেল না করে বরং আমার পরিবারকে সময় দিতে বারবার রিকোয়েস্ট করেছিল এবং খোঁজ-খবর নিত। উইতে না থাকলে আমি জানতামও না যে কাস্টমাররা এত আন্তরিক হয়। যা হয়তো সম্ভব হয়েছে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য। এই পার্সোনাল ব্র্যান্ডিংও হয়েছে উইয়ের কল্যাণে।

যার কথা না বললেই নয়, আমাদের শ্রদ্ধেয় রাজীব আহমেদ স্যার, যিনি আমার উদ্যোক্তা জীবনের মেন্টর। তিনি উইর উপদেষ্টা ও ই-ক্যাবের সাবেক সভাপতি। তার কল্যাণেই ই-কমার্সের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো জানতে পেরেছি। কৃতজ্ঞতা জানাই উইর সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা আপাকে, উনি এত সুন্দর একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিলেন বলেই আজ আমরা আমাদের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে চলেছি। 

বর্তমানে আমি আমার ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে পাট, বেত ও বাঁশশিল্প যুক্ত করেছি। আমার স্বপ্ন শুধু দেশের ৬৪টি জেলা নয়, বিদেশের মাটিতেও আমার পন্য পৌঁছাবে।’’

লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী।