উদ্যোক্তা/ই-কমার্স

ই-কমার্স শুরুর আগে যা জানা জরুরি 

আমাদের দেশে যে কোনো চাকরির জন্য আবেদন করতে গেলে প্রথমেই চোখে আসে কত বছরের অভিজ্ঞতা চেয়েছে। আর সে আলোকেই আবেদন করি৷

যথেষ্ট পড়ালেখা করে একটি আর্কিটেকচার ফার্মে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে গেলেন। ইন্টারভিউতে প্রথম প্রশ্ন, এই সেক্টরে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা আছে? জবাবে আপনি বললেন, অমুক প্রতিষ্ঠানে এত দিন কর্মরত ছিলাম। আমার এত বছরের অভিজ্ঞতা আছে। এরপর যথারীতি প্রশ্নের জবাব ও আপনার বাহ্যিক দক্ষতার ভিত্তিতে চাকরিটা হয়ে গেলো।

বর্তমানে ই-কমার্স সেক্টরে তরুণদের অনেক ঝোঁক বেড়েছে। অনেকেই পড়াশোনা শেষ করেই ই-কমার্স সেক্টরে ক্যারিয়ারের জন্য ঝুঁকে পড়ছেন। এটা নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো দিক। দেশের তরুণ প্রজন্ম অনেকটা স্বাধীন থাকতে পচ্ছন্দ করেন। ফলে নিজের সৃজনশীলতা কাজে লাগাতে ও নতুন কিছু করার প্রত্যয়ে স্বপ্ন দেখছেন। 

চাকরিতে আবেদন করার জন্য নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার সময়সীমা নির্ধারণ করা থাকলেও ই-কমার্স সেক্টরে কাজ করার জন্য কোনো অভিজ্ঞতার সময়সীমা থাকে না। কেননা এটি নিজস্ব চিন্তাভাবনার সৃজনশীলতা থেকে আসে।

অভিজ্ঞতা হীন ও বিজনেস ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী ছাড়া ই-কমার্স সেক্টরে কাজ করার জন্য এ সম্পর্কে জানা অতিব গুরুত্বপূর্ণ। শেখার জন্য তেমন প্রতিষ্ঠান না থাকায় অনেকেই বিপাকে পড়েন। এদিক থেকে ডিএসবি (ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ) নামক ফেসবুক গ্রুপটি সেরা। তথ্য প্রযুক্তি ও ব্যবসা সম্পর্কিত জ্ঞানের সমন্বয়কৃত একটি প্ল্যাটফর্ম এটি। যেখান থেকে খুব সহজেই বিনা পয়সায় শেখা সম্ভব। লাখো মানুষ এখন শিখছেন ডিএসবিতে।

আপনারা যারা ই-কমার্স নিয়ে নতুন ও অনভিজ্ঞ বলে নিজেদের দাবি করছেন, আসলে কিন্তু তা নয়, আপনারা সবাই কিন্তু ব্যবসা সম্পর্কে নিয়মিত অবগত ও মোটামুটি অভিজ্ঞ। প্রতিদিন আমরা কিছু না কিছু কিনি বা বেচি। সেটা কী, এটা নিয়ে একটু ভাবুন। ভাবতে ভাবতে দেখুন নিজের মেধা কিন্তু কাজ করতে শুরু করছেন। এটাই আমরা কম করি, যা করা দরকার সবার আগে।

যাইহোক, আমরা প্রতিদিন টাকার বিনিময়ে কিছু কিনি বা বিক্রি করি। মানে আমাদের কেনা বেচার মূখ্য মাধ্যম হলো টাকা। আর একটু সহজ করে বলি আমরা টাকাকে বিক্রি করি কেনো? বিক্রি করেই কিন্তু কোনো একটি পণ্য বা সেবা গ্রহণ করি। তার মানে প্রতিদিন আমরা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছি। এই টাকা বিক্রি করে আমরা লাভবান হই। কেনো হই? কারণ আমরা যখন কোনো পণ্য কিনি, সেটা নিজে যতক্ষণ লাভবান না হই ততক্ষণ কিনি না। তার মানে আমরা টাকা বিক্রি করে লাভবান হচ্ছি আর সেটা প্রতিনিয়ত।

একটি পরিবার বছরে ৬০০ এর বেশি পণ্য লেনদেন করে। প্রায় ২৫০ মোকামে গড়ে ১৫০০ বার টাকা বিক্রির লেনদেন করে। তাহলে একবার ভাবুন আপনি বছরের প্রতিটি সময় ই-ব্যবসার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন, তবুও আমরা নিজেকে অনভিজ্ঞ ভাবি। আমাদের চোখে ব্যবসা মানে হলো অনেক টাকা বিনিয়োগ করে সেটা দৃশ্যমান থাকা। অথবা কোনো শো-রুম দিয়ে পণ্য গুদামজাত করে বেচাকেনা। এর বাইরে থেকে আমরা এখনো বের হয়ে আসতে পারিনি। 

গতানুগতিক ব্যবসায় একটি দোকান বা শোরুম নিয়ে পণ্যগুলো সাজিয়ে ব্যবসা করা হয়। তার আগে বলি, ব্যবসা আর ব্যবসায়ী দুটোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ব্যবসা আর ব্যবসায়ী দুটো আলাদা সত্তা। আপনি নিজে একজন ব্যক্তি আর আপনার প্রতিষ্ঠান আরেকটি সত্তা। আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন। সেখান থেকে আপনাকে লভ্যাংশ দেবে। আবার একটা সময় বিনিয়োগও ফেরত দেবে। আপনি সেবা দেবেন, এটা ব্যবসা। আর আপনি একজন ব্যক্তি হয়ে যখন আপনার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, তখন নিজের পরিশ্রমের পারিশ্রমিক নিচ্ছেন না। অর্থ্যাৎ এটাও বিনিয়োগ করছেন, তাহলে এটা হলো ব্যবসায়ী।

ই-কমার্স সেক্টরে কাজ শুরু করার আগে আপনাকে ব্যবসায়ের প্রাথমিক কিছু ব্যাপার জানা দরকার। প্রথমত অন্যসব কাজের মতো ব্যবসায় ক্ষেত্রেও তিনটা জিনিস প্রযোজ্য। আপনি কী করছেন? কীভাবে করছেন? আর কেন করছেন? এই তিনটা বিষয় আপনার কাছে পরিষ্কার হওয়া উচিত। আরো সহজ করে বললে আপনি কী বিক্রি করবেন, কীভাবে করবেন এবং কেন বিক্রি করবেন? এই তিনটা প্রশ্ন এবং সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আপনার স্বচ্ছ থাকতে হবে।

আপনি কী বিক্রি করবেন? আপনি যে পণ্যটি নিয়েই কাজ শুরু করেন না কেনো সেটা নিয়ে আপনাকে আদ্যপ্রান্ত জানতে হবে। পণ্যটি কোথায় পাওয়া যায়, কীভাবে উৎপাদন হয়, বাজারে চাহিদা কেমন, বাজারে এগুলো কীভাবে বিক্রি হয়? পণ্যের গুণগত মান পণ্যের ব্যবহারবিধিসহ বিস্তারিত আপনাকে জানতে হবে।

কীভাবে বিক্রি করবেন? ই-কমার্স মানেই তো অনলাইন। অবশ্যই অনলাইনেই বিক্রি করবেন। তবে অনলাইনে বেচার জন্য যত যত মাধ্যম আছে, সেগুলোকে জানতে হবে। পণ্যটি অনলাইনে বিক্রি হলেও হাতে পৌঁছাবে অফলাইনে। মানে কীভাবে কাস্টমার হাতে পাবে, সেগুলো নিয়েও স্বচ্ছ ধারণা রাখতে হবে। আপনার পণ্যটি নিয়ে বাজারে অনেকেই কাজ করেন, তাদের কাছ থেকে না নিয়ে আপনার থেকে কেনো নেবে? তাহলে অবশ্যই কোয়ালিটি ভালো হতে হবে। আর তা নিয়ে অনলাইনে কাজ করতে ও জানতে হবে।

কেন বিক্রি করবেন? আপনি যে পণ্য নিয়েই কাজ করুন না কেনো, আপনাকে প্রথমেই চিন্তা করতে হবে এই পণ্যটি দেশের মানুষের জন্য ও দেশের জন্য কী উপকারে আসবে? মানুষ এটি কেনো কিনবে? এটা কিনলে কী উপকার পাবে? আপনার পণ্য থেকে মানুষ কোন ধরনের ইতিবাচক সেবা পাবে? সেগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে।

আপনার প্রচারণা ও পণ্য দেখে যদি কোনো ব্যক্তি কিনতে আগ্রহী হয়, তাহলে তাকে কনভিন্স করে পণ্য বিক্রি করাটা আসল চ্যালেঞ্জ। মনে রাখতে হবে আপনার মার্কেটিং দক্ষতা ও প্রেজেন্টেশনের উপর পণ্য বিক্রি নির্ভর করে। অবশেষে পণ্যটি যখন ক্রেতা কিনতে আগ্রহী হয়, তখন ক্রেতাকে পণ্যটি সম্পর্কে সুনিশ্চিত ধারণা ও মোটিভেট করতে হবে। মনে রাখবেন, একজন ক্রেতা আপনার পণ্যটিই শুধু কেনে না, কেনে সেবাটাও। 

একজন মানুষ একটা ড্রেস কেনার পর তিনি আশা করেন তিনি এটা ৬ মাস ব্যবহার করতে পারেন। এটা পণ্যের ৬ মাসের সার্ভিস। এমনকি একজন মানুষ একটা জুস কেনার পর তিনি আশা করেন এটা তাকে ব্যাপক তুষ্টি ও পুষ্টি দেবে। এটাও একটা সার্ভিস। কাজেই এগুলো জেনে-শিখে আপনাকে ই-কমার্স সেক্টরে আসতে হবে।

লেখক: স্বত্বাধিকারী, বিডিম্যানগ্রোভ।