উদ্যোক্তা/ই-কমার্স

কিছু পণ্যের ছবি ছিল আমার ব্যবসার মূলধন: নিপা 

শারমিন ইসলাম নিপা, জন্ম কুমিল্লায়। এসএসসি পরীক্ষার পর বাবার চাকরির সুবাদে পুরো পরিবার ঢাকায় স্থানান্তর হয়। ঢাকার শহীদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ইন্ডিপিন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ থেকে বিবিএ এবং এমবিএ শেষ করেন। অধ্যয়নরত অবস্থায় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিয়ে হয় নিপার। বিয়ের পর গ্র্যাজুয়েশান শেষ করেন নিপা। এমবিএ শেষ হয় ২০২০ সালে।

নিপা বলেন, ‘‘মূলত আমার পড়ালেখা শেষে যখন আমি চাকরির চেষ্টা করছিলাম তখনই দেশে করোনার কারণে লকডাউন শুরু হয়ে যায়। তারপর ঘরে বসে কিছু করার চিন্তা করতে করতে হঠাৎ মাথায় আসলো অনলাইন বিজনেসের কথা। ছোটবেলা থেকেই আমি সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। আমি ঘরে বসে থাকবো না অবশ্যই নিজের একটা আলাদা পরিচিতি তৈরি করবো। যদিও আমার চাকরি করার ইচ্ছে ছিল কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কিন্তু বিয়ে হয়েছে ব্যবসায়ী পরিবারে। সেই থেকে আমার স্বামীর অনুপ্রেরণায় ব্যবসায়ী জীবনে পা দেওয়া। 

আমার শ্বশুরবাড়ি সিরাজগঞ্জ, সবাই তাঁত ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বিয়ের পর আমি প্রথম তাঁতের মেশিনের আওয়াজ শুনি। এর আগে তাঁত নিয়ে কোনো ধারণা ছিল না আমার। আমাদের তৈরি শাড়ি, লুঙ্গী পুরো বাংলাদেশে সাপ্লাই হয়। তখন আমার মাথায় আসলো আমাদের শাড়ি নিয়ে সবাই বিজনেস করছে। আমি তাহলে কেনো বসে আছি, এত সুন্দর সুযোগ কাজে লাগাচ্ছি না। সিরাজগঞ্জের খুকনী এলাকায় আমার শ্বশুরবাড়ি। দিন রাত ২৪ ঘণ্টা তাঁতের খট খট আওয়াজ শুনতে শুনতে আমি তাঁত নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন বুনতে থাকি। আমাদের ফ্যামিলি সব বিজনেস হোলসেল রিলেটেড, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের সব শোরুম হোলসেল বেসিক। আমি মূলত রিটেইল দিয়ে শুরু করেছিলাম কিন্তু এখন আমার কাছ থেকে শাড়ি নিয়ে অনেক আপুই বিজনেস করছেন। 

আমি সবাইকে সোর্স হিসেবে সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছি। শাড়ি সম্পর্কে বিস্তারিত শিখছি আমি আমার শ্বশুরের কাছ থেকে। শাড়ি বুনন, কাউন্ট, ম্যাটেরিয়াল সব কিছু উনি আমাকে বুঝিয়ে দেন। তিনি আমাকে অনেক সাপোর্ট করেন সব দিক থেকে। তিনি সিরাজগঞ্জের নামকরা একজন ব্যবসায়ী। কখনো আমার কাজকে ছোট করে দেখেননি। আর যার কথা না বললেই নয়, তিনি আমার স্বামী। সে ছায়ার মতো আমার পাশে ছিল। সে পাশে না থাকলে ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখার সাহস আমি পেতাম না।’’ 

নিপা আরো বলেন, ‘‘আমার শুরুটা ফেসবুক গ্রুপ উই (উইমেন্স অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) থেকে। উইর আপুদের গল্প পড়ে নিজের মধ্যে আলাদা রকম কনফিডেন্স পেলাম। উইতে পোস্ট করার দ্বিতীয় দিনে আমি প্রথম অর্ডার পাই। সেই থেকে কোনো দিন আমার আর অর্ডার থেমে থাকেনি। উই থেকে, পেজ থেকে প্রতিদিন অর্ডার আসতে থাকে। শুধু উইতে আমার মোট বিক্রি হওয়া পণ্যের অর্থমূল্য মাত্র ৬ মাসে ৬ লাখ টাকা আর পেজ থেকে ২ লাখ টাকা। 

একদম শূন্য পুঁজিতে আমার বিজনেস শুরু। আমি আমাদের দোকানের কিছু শাড়ির ছবি তুলে পোস্ট করা শুরু করি, সেখান থেকেই অর্ডার আসতো। ওখান থেকেই ডেলিভারি দিতাম। কোনো স্টক করতাম না। কিন্তু এখন আমার কিছু স্থায়ী কাস্টমার আছেন, এজন্য আমাকে আলাদা স্টক মেইন্টেইন করতে হয়। কারণ আমার কাছ থেকে শাড়ি নিয়েই অনেকে বিজনেস করছেন। তাদের সবসময় সাপ্লাই দিতে হয়।’’ 

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হিসেবে আমার পেজ ‘Shariowala-শাড়িওয়ালা’কে তাঁত পণ্যের প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তোলা। আর একটা শো-রুম চালু করা। যেখান থেকে সবাই ইচ্ছে মতো দেখে শাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন। আমার পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের বাইরেও গিয়েছে বেশ কয়েকবার। আর এখন আমি নিজেই DHL এ প্রোডাক্ট পাঠাচ্ছি কানাডায়। চ্যালেঞ্জের কথা বলতে গেলে তেমন কিছুই ফেস করতে হয়নি। যেহেতু আমার পরিবার আমার শক্তি, আমাকে সবসময় সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু একটা জিনিস খুব ফেস করেছি। অনেকেই বলতো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে এত টাকা খরচ করে পড়ে শাড়ি বেচে। যদিও একথাগুলো আমি পাত্তা দেইনি। 

হাস্যকর ব্যাপার হলো এরাই আমার কাছে উপদেশ নিতে আসেন অনলাইন বিজনেস শুরু করবে তাই। আমাদের সমাজে একটা ট্যাবু এখনো আছে, অনেকে মনে করেন, যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল, তারাই অনলাইন বিজনেস করেন। এখন একটু চোখ খুলে দেখলেই বুঝবেন সব প্রতিষ্ঠিত ফ্যামিলির শিক্ষিত মেয়েরাই অনলাইন ব্যবসা নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। 

আসুন সবাইকে সম্মানের চোখে দেখি। কারো কথায় কান না দিয়ে নিজের মতো কাজ করে যাই। সময় কথা বলবে। নিজের উপর বিশ্বাস থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে না। সবকিছুর জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ শুকরিয়া, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে। কৃতজ্ঞতা আমার পরিবার আর আমার প্রিয় ভাইয়া-আপুদের কাছে, যাদের ভালোবাসায় এ পর্যায়ে এত কম সময়ে আসতে পেরেছি।’’

লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী।