উদ্যোক্তা/ই-কমার্স

ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে উদ্যোক্তা মৌ

মাছুমা আনজুম মৌ, জন্ম বগুড়ায়। বাবা-মার তিন মেয়ের মধ্যে মৌ দ্বিতীয়। বাবা একজন সোনালী ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং মা গৃহিণী। বাবা ব্যাংকার হওয়ার কারণে ছোটোবেলা থেকেই মৌয়ের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে বাবার মতো ব্যাংকার হবেন ও বাবার ছেলে নেই যেহেতু, সেহেতু মেয়ে হয়ে ছেলের মতো তিনি বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াবেন। 

বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ২০০৭ সালে পড়ালেখার কারণে মৌ চলে আসেন ঢাকায়। যেহেতু তার স্বপ্ন ছিল বাবার মতো ব্যাংকার হওয়া, ফলে বিবিএর সাবজেক্ট হিসেবে ফ্যাইনান্সকে বেছে নেন মৌ। অনার্স তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন সময় মৌয়ের বিয়ে হয়। বিয়ের পরেও মৌ পড়ালেখা চালিয়ে যান। অনার্স শেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করা অবস্থায় ২০১৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জব পেয়ে যান দেশের স্বনামধন্য ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউট লংকা বাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেডে। 

মৌ বলেন, ‘‘জবের এক বছর শেষ হতেই ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বরে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির জন্য আমার একটি মেজর অপারেশন হয়। একই সময় আমার স্বামী এক বছরের জন্য চায়নাতে একটি কোর্সের জন্য সিলেক্ট হন। এমন অবস্থায় কোনোভাবেই আমাকে দেশে রেখে আমার স্বামীর একা যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। ফলে জব ছেড়ে দিতে হয় এবং স্বামীর সঙ্গে এক বছরের জন্য চায়না চলে যাই। 

এক বছর পর দেশে ফিরে এসে আমি আবার ও জব খোঁজ করতে থাকলাম। ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারিতে এবি ব্যাংকে জয়েন করি। আর জব করার কারণে আমি থাকতাম ঢাকায় আর আমার স্বামী থাকতো কক্সবাজার। কিন্তু দ্বিতীয় বার আবারও সন্তান সংক্রান্ত জটিলতার কারণে এক পর্যায়ে এসে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি বাধ্য হলাম জব ছেড়ে দিতে। জব ছাড়ার ৩ মাস পরেই করোনার জন্য সারাদেশ লকডাউন হয়ে যায়। 

লকডাউনে সারাদিন বাসায় একা থাকতাম। এর মাঝে জুলাইতে কক্সবাজার থেকে আমার স্বামীর ঢাকায় পোস্টিং হয়। তখন ঘরে বসে কিছু করার চিন্তা করতে করতে হঠাৎ মাথায় আসলো অনলাইন বিজনেসের কথা। ছোটবেলা থেকেই আমি ডিটারমাইন্ড ছিলাম। আমি ঘরে বসে থাকবো না অবশ্যই নিজের একটা আলাদা আইডেন্টিটি তৈরি করবো। এর মাঝে ফেসবুক গ্রুপ উইর (উইমেন্স অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) সব আপুদের সাফল্যের গল্প পড়ে নিজে উদ্যোক্তা হওয়ার অনুপ্রেরণা পেলাম এবং নিজের মধ্যে আলাদা রকম আত্মবিশ্বাস তৈরি হলো। তখন চিন্তা করতে থাকলাম আমার উদ্যোগকে কীভাবে বাস্তব রূপ দেওয়া যায়। 

অল্প বয়স থেকে আমার শাড়ি এবং ফ্যাশনের দিকে অনেক আগ্রহ থাকার কারণে আমার মনে হলো, মেয়েদের শাড়ি এবং গহনা আমার ব্যবসার মূল বিষয় হিসেবে বেছে নিলে খুব সহজেই আমার বিজনেসকে এগিয়ে নিতে পারবো। এছাড়া মসলিন শাড়ির প্রতি আমার আগ্রহ ছিল আগে থেকেই, তাই মসলিন শাড়ি এবং আমাদের দেশের তৈরিকৃত গহনাকে আমার ব্যবসার প্রধান পণ্য হিসেবে বেছে নেই। 

২০২০ সালের ১ নভেম্বর প্রথম আমার ‘UniqueO’ পেজের যাত্রা শুরু এবং ২ নভেম্বর প্রথম উদ্যোক্তা হিসেবে উইতে পোস্ট করি। আল্লাহ্র অশেষ রহমতে আমি অনেক ভালো সফলতা পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ। আমার পণ্য দেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের বাইরেও গিয়েছে বেশ কয়েকবার।’’ 

তিনি আরো বলেন, ‘আমার পুঁজি হিসেবে ছিল খুব অল্প কিছু শাড়ি এবং গহনা। এরপর আস্তে আস্তে শাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি করি। সেই শাড়িগুলোর ছবি তুলে পোস্ট করা শুরু করি। সেখান থেকেই অর্ডার আসতো। আমি খুব বেশি শাড়ি এবং গহনা স্টক করতাম না।’ 

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে মৌ বলেন, ‘‘ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আমার পেজ ‘UniqueO’ কে মসলিন শাড়ি এবং আমাদের দেশের তৈরিকৃত গহনার প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তোলা। আর একটা শো-রুম চালু করা। যেখান থেকে সবাই ইচ্ছে মতো দেখে শাড়ি এবং শাড়ির সঙ্গে মানানসই গহনা নিয়ে যেতে পারবে। চ্যালেঞ্জের কথা বলতে গেলে, যেহেতু আমি এই লাইনে নতুন তাই মসলিন শাড়ি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে হয়েছে। কোথায় স্বল্প মূল্যে সেরা মানের পণ্য পাওয়া যাবে এটা খুঁজে বের করতে হয়েছে। 

এছাড়া আমার পেজ নতুন হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত নতুন সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তার সঙ্গে কীভাবে আমার ব্যবসার উন্নয়ন, প্রসারন এবং নতুনত্ব আনা যায় এটা আমার ব্যবসার চলমান চ্যালেঞ্জ। সব কিছুর পরে আমার পরিবার সবসময় আমার শক্তি এবং সাহস জুগিয়েছে। আমার স্বামী কখনো আমার কাজকে ছোট করে দেখেনি। সে সবসময় আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। 

এছাড়া আমার বড় বোন যে সবসময় ছায়ার মতো আমার পাশে ছিল। সে পাশে না থাকলে ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখার সাহস পেতাম না। আমি কখনো হতাশ হইনি। কখনো হাল ছাড়িনি। আমার জীবনে অনেক উত্থান-পতন এসেছে, কখনো মনের জোর হারাইনি। সবসময় চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। নিজের উপর বিশ্বাস রেখেছি। আত্মবিশ্বাস থাকলে, লক্ষ্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে না। সব কিছুর জন্য আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে। 

আমার পরিবার আর আমার প্রিয় ভাইয়া আপুদের কাছে, যাদের ভালোবাসায় এই পর্যায়ে এত কম সময়ে আসতে পেরেছি। সবশেষে এই নারী দিবসে বলতে চাই, প্রতিটি নারী নিজের আপন শক্তিতে আলোকিত করুক এই বিশ্বকে। সব নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।’’

লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী।