উদ্যোক্তা/ই-কমার্স

দুই ভাইয়ের ব্যতিক্রম উদ্যোগ ‘রেডিমিট বিডি’

‘রেডিমিট বিডি’ দুই ভাই এর সম্মিলিত উদ্যোগ। চেয়ারম্যান মো. শেখ রহমত উল্লাহ, চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) মোহাম্মদ মুনির হোসাইন। 

পৈত্রিক নিবাস চট্টগ্রাম জেলাতে হলেও তাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার মোহাম্মদপুরে। মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাশের পর ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করেছেন মুনির। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে পরিবারের ছোট সন্তান মুনির। বর্তমানে মোহাম্মদপুরেই তাদের বসবাস এবং সেখানেই দুই ভাই মিলে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। 

সম্প্রতি রাইজিংবিডিকে তাদের উদ্যোগের গল্প বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাইজিংবিডির উদ্যোক্তা/ ই-কমার্স পাতার কন্ট্রিবিউটর লেখক ও বিডিম্যানগ্রোভ ডটকমের স্বত্বাধিকারী সালাউদ্দিন আহমেদ।     

রাইজিংবিডি:  ব্যবসা শুরুর গল্পটা যদি বলতেন।  

মোহাম্মদ মুনির হোসাইন: যে কোনো উদ্যোক্তার জন্য তার উদ্যোগের শুরুর পথটা সহজ হয় না। উদ্যোগের শুরুতে উদ্যোগের পণ্য ঠিক করা, পণ্যের সোর্সিং, কোয়ালিটি নিশ্চিত করা, প্যাকেজিং, ডেলিভারি ইত্যাদি বিষয়ে তেমন জ্ঞান থাকে না। এসব কারণে ব্যবসার শুরুটা অনেকের জন্যই কঠিন হয়ে যায়।

আমাদের উদ্যোগ রেডিমিট বিডি যাত্রা শুরু করে ২০২০ সালে৷ রেডিমিট বিডি'কে পরিচিত করাতে আমরা কোরবানি ঈদকে টার্গেট করে ‘কোরবানি প্রজেক্ট’ হাতে নিই। এই প্রজেক্টে আমরা মার্কেটিং, ডিজাইনিং, প্যাকেজিং এমন কী সোর্সিং নিয়েও বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছি। উপস্থিত বুদ্ধি আর ধৈর্য্যের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে একটি সফল কোরবানি প্রজেক্ট সমাপ্ত করেছি আমরা।

রাইজিংবিডি: কোন ধরনের পণ্য নিয়ে কাজ করছেন ?

মোহাম্মদ মুনির হোসাইন: আমাদের উদ্যোগের নাম হচ্ছে ‘রেডিমিট বিডি’। নাম থেকেই ধারণা করা যায় আমরা মিট নিয়ে কাজ করি। তবে আমাদের বিশেষত্ব হচ্ছে আমরা রেডি টু কুক হালাল, অর্গানিক এবং ফ্রেশ গোশত নিয়ে কাজ করি। যা কোনো ধরনের কাটা-ধোয়ার ঝামেলা ছাড়াই সরাসরি রান্না করা যায়। আমরা গরু, মুরগি ও খাসির গোশত ক্রেতার চাহিদামতো রেডি টু কুক হিসেবে হোম ডেলিভারি দিয়ে থাকি। গরুর গোশতের বোন ইন এবং বোনলেস গোশতের পাশাপাশি রয়েছে গরুর ভুঁড়ি, পায়া, মগজ, কলিজা, মাথার গোশত ইত্যাদি। এখন পর্যন্ত আমাদের সর্বাধিক বিক্রিত পণ্য হচ্ছে গরুর ভুঁড়ি৷

মুরগির ক্ষেত্রে আমরা দেশি, সোনালী এবং ফার্মের মুরগির অর্ডার নিয়ে থাকি। সম্প্রতি আমাদের প্রোডাক্ট লাইনে চিকেন ড্রামস্টিক, উইংস, থাই, বোনলেস চিকেন ইত্যাদি পণ্য যুক্ত করেছি।

আমাদের সিগনেচার প্রোডাক্ট হচ্ছে খাসির গোশত । খাসির গোশতের পাশাপাশি আছে খাসির কলিজা, পায়া ইত্যাদি। আমাদের সার্ভিস এবং পণ্যের সব বিস্তারিত পাবেন আমাদের ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপে।

রাইজিংবিডি:  ঠিক কোন ধরনের চিন্তা ভাবনা থেকে রেডিমিটের চ্যালেঞ্জিং উদ্যোগ নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা ছিল? 

মোহাম্মদ মুনির হোসাইন:  ক্রেতারা সাধারণত বাজার থেকে নিজেরা গিয়ে গোশত কিনে নিয়ে আসেন। অনেকেই আছেন যারা গোশত ঠিকভাবে চেনেন না। এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ষাঁড় গরুর বদলে মহিষ বা গাভীর গোশত, খাসির বদলে ছাগি এবং দেশি মুরগির বদলে সোনালী মুরগি গছিয়ে দেয়। অনেক সময় এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা গোশত পানিতে ভিজিয়ে রাখে, সিরিঞ্জ দিয়ে গোশতে পানি পুশ করে গোশতের ওজন বাড়িয়ে ফেলে।

গোশত কিনে প্রসেস করা, বাজারে যাওয়া আসার সময় ব্যয় ও পরিবহন খরচের ঝামেলা এবং দুশ্চিন্তা থেকে ক্রেতাদের মুক্ত রাখার জন্যই কাঁচা গোশতের মত চ্যালেঞ্জিং একটা পণ্য নিয়ে কাজ করছে রেডিমিট বিডি।

রাইজিংবিডি:  ব্যবসার শুরুটা কি অনলাইন কেন্দ্রিক নাকি অন্য কোন উপায়ে ছিল?

মোহাম্মদ মুনির হোসাইন:  ২০২০ সালে ই-কমার্সের সঙ্গে পরিচিত হই। তখন থেকেই ইচ্ছা ছিল ই-কমার্স কেন্দ্রীক কোনো বিজনেস আইডিয়া ডেভেলপ করা। উদ্যোগ শুরু করি ফেসবুকে পেজ খোলার মাধ্যমে। অনলাইনের মাধ্যমে বিজনেস করার সহজ মাধ্যম হচ্ছে এফ-কমার্স এবং ই-কমার্স। এ দুটোকে কাজে লাগিয়েই অনলাইনে আমাদের উদ্যোগ শুরু করি আমরা।

রাইজিংবিডি: কাজ করতে গিয়ে কখনো বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন?

মোহাম্মদ মুনির হোসাইন:  আমাদের দেশে রেডি টু কুক আইডিয়াটা খুব বেশি পরিচিত না। আমরা চেষ্টা করছি রেডিমিট বিডি'র মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশে রেডি টু কুক আইডিয়াটা জনপ্রিয় করতে। যেহেতু রেডি টু কুক গোশত আমরা হোম ডেলিভারি দিয়ে থাকি তাই বাজারের মূল্যের তুলনায় আমাদের পণ্যের দাম কিছুটা বেশি মনে হয়। যদিও আমাদের প্রতিটি পণ্যের দাম রিজনেবল।

বাজারের দামের সঙ্গে তুলনা করে অনেকেই আমাদের পণ্যের দাম বেশি রাখছি বলে অভিযোগ করেন। এছাড়া ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশুনা শেষ করে কাঁচা গোশত নিয়ে কাজ করায় অনেকের কাছ থেকেই কটু কথা শুনেছি। এসব বিব্রতকর পরিস্থিতি সামলিয়ে ধীরে ধীরে উদ্যোগকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

রাইজিংবিডি:  নতুন উদ্যোক্তারা এই পেশায় আসতে চাইলে, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি ?

মোহাম্মদ মুনির হোসাইন:  নতুন উদ্যোগ শুরুর আগে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয়। বিজনেস আইডিয়া, কিভাবে বিজনেস ডেভেলপ করা যায়, মার্কেট এনালাইসিস, কাস্টমার সেগমেন্টেশন, বিজনেস প্লান ইত্যাদি জানতে হয়। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ থাকবে কোনো বিজনেস আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরুর আগে মিনিমাম ৬ মাস সেই বিজনেস আইডিয়া বা পণ্য নিয়ে পড়াশুনা করা, বিজনেস আইডিয়া এনালাইসিস করা। গুগল, ইউটিউব সার্চ করে এগুলো শেখা যায়। তবে অধিকাংশ তথ্যই ইংরেজিতে৷ কেউ যদি বাংলা ভাষায় সহজে এই বিজনেস টার্মগুলো শিখতে চায় তাদের জন্য সেরা প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে ফেসবুক গ্রুপ ডিএসবি (ডিজিটাল স্কিল ফর বাংলাদেশ)। ডিএসবিতে একজন উদ্যোক্তার দরকারি সব তথ্যই বাংলা ভাষায় পাওয়া যায়। শুধু দরকারি তথ্য সার্চ করে খুঁজে বের করতে হয়।

উদ্যোক্তার শক্তি হচ্ছে তার পড়াশুনা। ডিএসবিতে নিয়মিত সময় দিয়ে পড়াশুনা করলে খুব সহজেই নিজের বিজনেস আইডিয়া ডেভেলপ করা যায়৷ পাশাপাশি নিজের পারসোনাল ব্র্যান্ডিংও স্ট্রং করা যায়। তাই নতুন উদ্যোক্তাদের বলবো কাজ শুরুর আগে পড়াশুনায় মনোযোগ দিতে।

রাইজিংবিডি:  উদ্যোক্তা জীবনে সফল হতে কাদের ভূমিকা বেশি ছিল?

মোহাম্মদ মুনির হোসাইন:  সফলতার সংজ্ঞাটা আপেক্ষিক। হ্যাঁ, ভালো কিছু কাজ হয়ত করছি কিন্তু সফল হতে এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। সবার জীবনে একজন মেন্টর দরকার হয়। আমিও অনেকটা সময় মেন্টর খুঁজে বেড়িয়েছি যার দিক নির্দেশনায় ভালো কিছু করা যায়। ২০২০ সালে প্রায় একই সময়ে ব্যবসা নির্ভর ফেসবুক গ্রুপ উই (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) এবং ডিএসবিতে যুক্ত হই।  সেখানে ইক্যাবের (ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) সাবেক সভাপতি  রাজিব আহমেদ স্যারকে মেন্টর হিসেবে পেয়েছি। ই-কমার্স রিলেটেড স্যারের প্রতিটি পরামর্শ, আইডিয়া আমার উদ্যোগে দারুণভাবে কাজ করেছে। আমার উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে স্যারের পরামর্শ এবং ভূমিকা অনেক বেশি।

উদ্যোগ এগিয়ে যায় যখন আশেপাশের মানুষদের থেকে সাপোর্ট পাওয়া যায়। আমার পরিবার, ভাই-বোন, বন্ধুরা, ক্রেতাগণ একদম শুরু থেকেই আমাদেরকে সাপোর্ট করে যাচ্ছেন। উদ্যোক্তা জীবনে সফল হতে গেলে এদের সাপোর্ট সবসময় দরকার।

রাইজিংবিডি: বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপনার ব্যবসা নিয়ে ভবিষ্যতে কতদূর যেতে চান এবং পরিকল্পনা কি?

মোহাম্মদ মুনির হোসাইন:  আমরা আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনাকে বছর ভিত্তিক ভাগ করে নিয়েছি। এক বছর, দুই বছর, পাঁচ বছর ও দশ বছর হিসেবে ব্যবসার পরিকল্পনা করছি।

আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের মানুষদের কোয়ালিটি পূর্ণ গোশতের চাহিদা মিটিয়ে আমাদের সিগনেচার প্রোডাক্ট খাসির গোশত মধ্যপ্রাচ্য এবং স্ক্যান্ডেনেভিয়ান অঞ্চলের (আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক) দেশগুলোতে রপ্তানি করা। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থী স্ক্যান্ডেনেভিয়ান অঞ্চলে পড়তে যায়। তারা যেন নিশ্চিন্তে হালাল এবং ফ্রেশ গোশত খেতে পারেন সেটাই আমাদের চাওয়া।

রাইজিংবিডি: আপনার উদ্যোগের সফলতার কথা জানতে চাই?

মোহাম্মদ মুনির হোসাইন:  সফলতা আসতে অনেকটা সময় প্রয়োজন হয়। তবে এই ৮ মাসের যাত্রায় আমাদের সফলতা হচ্ছে ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জন এবং উদ্যোগের পরিচিতি বৃদ্ধি।

আমরা রেডি টু কুক মিট সার্ভিসে নতুন ভ্যালু যোগ করেছি। সাধারণত এক কেজির একটা মুরগি প্রসেস করার পর ৫৫০-৬০০ গ্রাম গোশত পাওয়া যায়, যা মূল এক কেজির থেকে প্রায় ৪০০-৪৫০ গ্রাম কম। আমরা এই গ্যাপটা পূরণ করে ক্রেতাকে পূর্ণ এক কেজি রেডি টু কুক গোশত সরবরাহ করে থাকি।

আমরা কোনো ফ্রোজেন পণ্য সরবরাহ করি না, পণ্যের কোয়ালিটিতে কোনো কম্প্রোমাইজ করি না।

আমাদের এই বিশেষত্বগুলো অন্য কোম্পানি থেকে আমাদেরকে আলাদা করেছে। এই সার্ভিস এবং পণ্যের কোয়ালিটি আমাদেরকে ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জন এবং পরিচিতি বৃদ্ধিতে সাহায্য করছে যা আমাদের সফলতার রাস্তা তৈরি করে দিচ্ছে।

রাইজিংবিডি:  উদ্যোক্তা জীবনের শুরু কতদিন এবং রেভিনিউ কেমন ?  

মোহাম্মদ মুনির হোসাইন: ২০২০ সালের ১১ জুলাই রেডিমিট বিডি'র যাত্রা শুরু হয়। সে হিসেবে প্রায় ৯ মাস চলছে আমাদের উদ্যোগের। সকলের ভালোবাসা ও সহযোগিতায় এখন পর্যন্ত রেডিমিট বিডি'র রেভিনিউ আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো। আমরা এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ টাকার অধিক পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিয়েছি।

রাইজিংবিডি: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ।

মোহাম্মদ মুনির হোসাইন: রাইজিংবিডিকেও অনেক ধন্যবাদ। উদ্যোক্তারা সামনে এগিয়ে যান তাদের পরিচিতির মাধ্যমে। রাইজিং বিডি'র আমাদের মতো নতুন উদ্যোক্তাদের কথা তুলে ধরে সবার কাছে পরিচিতি পেতে সাহায্য করছেন। আশা করি এভাবে অনেক নতুন উদ্যোক্তাদের কথা আমরা জানতে পারবো রাইজিং বিডি'র মাধ্যমে। রেডিমিট বিডি'র পক্ষ থেকে রাইজিং বিডি'কে আন্তরিক ধন্যবাদ।