পরিবেশ

চাই পরিকল্পিত বসতি, চাই পরিকল্পিত নগর

শাহ মতিন টিপু : নগর সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ একটি আধুনিক নগরের কথা চিন্তা-ভাবনা করেছে। প্রায় ছয় হাজার বছর আগে যখন মেসোপেটোমিয়ার টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকায় ব্যবিলন, উর ইত্যাদি প্রাচীন শহরগুলোর পত্তন হয় বা তার পরে নীল অববাহিকায় কাহুন অথবা সিন্ধু অববাহিকায় হরপ্পা-মহেঞ্জেদারো ইত্যাদি শহর গড়ে ওঠে তার অনেকগুলোই গড়ে উঠেছিল এক একটি আদর্শ রূপকল্পকে ভিত্তি করে।

 

একটি আদর্শ রাষ্ট্র বা দেশ গঠনে পরিকল্পিত নগরায়ন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে একটি সম্ভাবনাময় দেশ কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন থেকে ছিটকে পড়ে। আমাদের শহরগুলোও দিনে দিনে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। একটি সুন্দর বসবাসযোগ্য দেশ গঠনের পূর্বে একটি পরিকল্পনা জরুরী।

 

একবিংশ শতাব্দীতে উন্নত নগরায়ন মানুষের প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দুতে। জীবনযাত্রার অনিবার্য প্রয়োজনে মানুষ এখন নগরমুখী। সে কারণেই নগরায়নকে পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যকর ও সুষম হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। বলা যায়, নগরজীবনকে স্বাচ্ছন্দ্য, পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও উন্নয়নমুখি করা এখন সময়ের দাবি।

 

আসলে পরিকল্পিত নগর বলতে বুঝায় একটি পরিকল্পিত জনবসতি। যার সবকিছু হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী। কোথায় স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল হবে, অফিস-আদালত কোথায়, কোথায় বসবাসের জায়গা সবকিছুই হবে পরিকল্পনামাফিক। পরিকল্পনামাফিক সবকিছু হলে প্রত্যেক নগরেই মানুষ শৃঙ্খলাপূর্ণ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু এই নগরই আবার পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠলে তাতে নাগরিকদের জীবন অস্বস্তিকর হয়ে উঠে। জনজীবনকে তা বিপর্যস্ত করে ফেলে। মানুষের ভোগান্তির কোনো শেষ থাকে না।

 

একটি নগরীকে বসবাসের সুযোগ-সুবিধা, জনসংখ্যার ঘনত্ব, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ-সুবিধা, অপরাধের হার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন, পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামোর গুণগতমান, পানি সরবরাহের মান, খাদ্য, বিদ্যুৎ, পানীয়, ভোক্তাপণ্য এবং সেবা, সরকারি বাসগৃহের প্রাপ্যতা ইত্যাদি দিক বিবেচনা করে তাকে আদর্শ নগর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। এসব দিক থেকে আমাদের নগরগুলোর কী অবস্থা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

 

আজ বিশ্ব বসতি দিবস। প্রতি বছরের মত এ বছরও বাংলাদেশে জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব বসতি দিবস উদযাপিত হচ্ছে। এ বছর বিশ্ব বসতি দিবসের প্রতিপাদ্য ‘পাবলিক স্পেইসেস ফর অল’ সময়ের নিরিখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ উপলক্ষে প্রদত্ত বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় সুষ্ঠু, পরিকল্পিত আবাসন ও নগরায়ন নিশ্চিত করার আহবান জানিয়েছেন। তিনি ‘রূপকল্প ২০২১’কে সামনে রেখে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত নগরায়নকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করে যথাযথভাবে সকল প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলারও আহ্বান জানান।

 

রাষ্ট্রপতি বলেন, নগরায়ন ও শিল্প প্রসারের লক্ষ্যে নিত্য নতুন শিল্পাঞ্চল সৃষ্টি, জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপে আবাসন সৃষ্টিসহ নানাবিধ কারণে সাধারণ মানুষের চলাচল ও প্রবেশ উপযোগী সার্বজনীন স্থানের সংকুলান বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পার্ক, সমুদ্র সৈকত, সামাজিক স্থান, রাস্তা-ঘাট ও ঐতিহাসিক স্থান সংলগ্ন উন্মুক্ত জায়গা উন্নয়নশীর দেশসমূহে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে সার্বজনীন এসব স্থানে সর্বসাধারণের চলাচল ও প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে আসছে যা কখনোই কাম্য নয়।

 

তিনি বলেন, নগরমুখী মানুষের ঢল ঠেকাতে পরিকল্পিতভাবে গ্রাম ও পল্লী এলাকার উন্নয়ন করতে হবে এবং কর্মসংস্থানসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতেও পদক্ষেপ নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানাবিধ কারণে বসতি সমস্যা এখন বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত প্রকট। রাষ্ট্রপতি এ সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

 

দিবসটি  উপলক্ষে প্রদত্ত বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিকল্পিত নগরায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা ‘বিশ্ব বসতি দিবস ২০১৫ উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীদের পরিকল্পিত নগরায়ন সৃষ্টিতে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান।

 

শেখ হাসিনা বলেন, বেসরকারি আবাসন শিল্পে সুষ্ঠু ভূমির ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমরা বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছি। এ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট পুরাতন অন্যান্য আইন ও বিধিমালা যুগোপযোগী করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমাদের এ সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে গৃহায়ন ও আবাসনখাতে প্রণিধানযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

 

শেখ হাসিনা বলেন, হাতির ঝিল এলাকায় সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে রাজধানী ঢাকার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসন, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

 

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চল ভিত্তিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান নিশ্চিত করে সকলের ব্যবহারযোগ্য আবাসন ও নগরায়ন সংক্রান্ত কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি, এ সব কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে গৃহায়ন ও আবাসনখাতে প্রণিধানযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন।

 

আসলে পরিকল্পিত নগরায়ন খুবই জরুরি। সারা পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত নগরের জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে এবং সেইসাথে নগরের সুযোগ সুবিধার উপর প্রচণ্ড চাপ বাড়ছে । নগরের সমস্যা গুলো দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে । নগরের আর এক ধাপ হচ্ছে মেগাসিটি, যে শহরের জনসংখ্যা ১ কোটি থেকে এক কোটির উপরে সেই সব শহরকে মেগাসিটি বলা হয়। সেই হিসেবে পৃথিবীতে এখন ৩২টির মত মেগাসিটি আছে ।

 

এমনই এক মেগাসিটি ঢাকা। বলা যায়, বসবাসকারীদের জন্য এক অভিশাপ এবং অভিভাবকহীন ঢাকা শহর । সম্ভবতঃ ঢাকা হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে বসবাসের অনুপযোগী শহর অর্থাৎ নিকৃষ্ট শহর । ঢাকা বসবাসের উপযোগী করতে সরকারের তেমন কোন তদারকি নেই, ঢাকায় যতটুক পরিকল্পনা মাফিক হয় তা বেসরকারিভাবে।

 

দেশের নগরাঞ্চলের বহুমুখি সংকট উত্তরণে জাতীয় পর্যায়ে একটি ভৌত পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে কোথায় শহর ও শিল্পাঞ্চল হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে দিতে হবে। কৃষিজমি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই সংক্রান্ত বর্তমান বিশৃঙ্খলা যতটা সম্ভব দূর করে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কঠোর হতে হবে। তবে এই পরিকল্পনার আগে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থাকা দরকার।

 

ঢাকা শহরটি গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে। পুরোনো ঢাকার ঘিঞ্জিময় এলাকায গেলেই বোঝা যায় নগর ব্যবস্থাপনা কতটা অপরিকল্পিত। পুরোনো ঢাকায় কোনো ফাঁকা জায়গা নেই। রাস্তাগুলোও বেশ সরু। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাওয়ার পথটুকু দুজন মানুষের চলার মতো নয়।

 

একই ভাবে গড়ে উঠছে নতুন ঢাকায়। বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্র কোনো রকম পরিকল্পনা নেই। যত্রতত্র গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। বাড়ির মালিকরা অনুমোদনেরও তোয়াক্কা করছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা থোরাই কেয়ার করছে তারা।

 

এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার এখনও সময় আছে। রাষ্ট্র, দেশপ্রেমিক জনতা ও শিক্ষিত সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশবান্ধব নগরায়ন, শিল্পায়ন, পাশাপাশি যানবাহন ব্যবহার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনেও পরিবেশকে প্রাধান্য দিতে হবে। শহরের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করতে হবে গ্রামের সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে। ফসলি জমির সুষম ব্যবহার, পরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ, পুকুর ও অন্যান্য জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং জনসচেতনতার মাধ্যমে উন্নয়নভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।

 

পরিবেশের সার্বিক অবস্থা নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক সামাজিক অবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ওপর। পরিকল্পিত উন্নয়ন ব্যবস্থা যেমন মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে তেমনি হয় পরিবেশবান্ধব। অপরদিকে অপরিকল্পিত উন্নয়ন সাময়িকভাবে মানুষের উপকারে এলেও পরিণামে পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনে। তাই পরিবেশ এবং মানুষ উভয়ের জন্যই প্রয়োজন সুষম উন্নয়ন ব্যবস্থা।

 

যার কাজ সে যদি না করতে পারে তাহলে এই শহর বাসযোগ্য হবে কিভাবে ? আমাদের ঢাকাকে সামনে ৫০ বছর পর কেমন দেখতে চাই তা ভাবতে হবে। এখনি সময় ঢাকাকে পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলার, শুধু পরিকল্পনা বানিয়ে রেখে দিলে হবে না প্রয়োজন পরিকল্পনার শতভাগ বাস্তবায়ন।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ৫ অক্টোবর ২০১৫/টিপু