ফাগুনের মলাট

‘বইয়ের মান যাচাইয়ে প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত’

রফিকুর রশীদ কথাসাহিত্যিক, গীতিকার, শিক্ষাবিদ। সত্তর দশকের শেষদিকে লেখালেখি শুরু করলেও সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি পান নব্বই দশকের প্রারম্ভে। বহুমাত্রিক সৃজন কুশলতার অধিকারী তিনি। লিখেছন নানা বিষয় নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন অসংখ্য গল্প ও উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, জসীম উদ্‌দীন ও বঙ্গবন্ধুর জীবনালেখ্য নিয়ে গল্প লিখেছেন। বাংলাদেশের মানুষ, তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছে তার গল্প উপন্যাসে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে আসেন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রাইজিংবিডি ডটকমের স্টলে। এ সময় সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ, বই, লেখক, পাঠক ও বইমেলা নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফ বরকতুল্লাহ। সাইফ বরকতুল্লাহ : বইমেলা কেমন লাগছে? রফিকুর রশীদ : ভালো লাগছে। অন্যান্য বারের তুলনায় এবারের মেলা বেশি নান্দনিক বলে মনে হচ্ছে। আমি এসেছি ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে। মেহেরপুর থেকে। ঐতিহাসিক মুজিবনগর থেকে। এসেই বাস থেকে এক বাসায় ব্যাগ রেখে চলে এসেছি। মেলার জন্য প্রতিবারই টান থাকে। এবারও সেই টানেই চলে এসেছি। আর এবার আমার বই আসছে। সাইফ বরকতুল্লাহ : এবার আপনার কী কী বই এসেছে? রফিকুর রশীদ : এ পর্যন্ত চারটি বই এসেছে। আরো ছয়টি বই আসবে এ সপ্তাহের মধ্যেই। সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনি তো দীর্ঘদিন ধরেই মেলায় আসছেন, মেলা দেখছেন। সেই সময়ের বইমেলা আর আজকের বইমেলার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান কি না? রফিকুর রশীদ : মেলায় আসছি প্রায় ২০-২৫ বছর ধরে। হ্যাঁ, পার্থক্য একটা দেখতে পাই। মেলায় এখন জনসমাগম বেড়েছে, পাঠক সমাগম বাড়েনি। এটাই সবচেয়ে বেদনার কথা। আর শ্লাঘার বা আনন্দের কথা- আসছে তো মানুষ। বইয়ের পাতা উল্টে দেখছে তো! এই দেখতে দেখতেই যে কিনছে কিনছে, যে পড়ছে পড়ছে। বইয়ের জন্য মেলা হয়, সেখানে মানুষকে যেতে হয়- এই যে আনন্দের এই প্রবাহ, এটা টিকে থাকুক। মানুষ এক সময় আবারও বইমুখী হবে আমি আশাবাদী। সাইফ বরকতুল্লাহ : ফেব্রুয়ারি মাস এলেই, বইমেলা এলেই বই উৎসব, প্রচুর বই প্রকাশিত হয়। মিডিয়ায় ব্যাপক কাভারেজ পায়। কিন্তু বছরের অন্য মাসগুলোতে তা হয় না। আপনার ভাবনা কী? রফিকুর রশীদ : এর জন্য লেখকেরা ততটা দায়ী নয়। এর জন্য দায়ী আমি মনে করি প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যারা যুক্ত, সৃজন প্রতিবন্ধী কিছু মানুষ প্রকাশক হয়েছেন। তারা নিজেরা লেখালেখি খুব একটা করেন না। পড়ালেখাও করেন না। কী করে বই প্রমোট করতে হবে, কী করে বইকে দেশময় ছড়িয়ে দিতে হবে, বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে কী করে বই ছড়িয়ে দিতে হবে- এসব নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার মানুষ কই? এক-দুজন আছেন। ফলে পাঠকদের সামনে সারা বছর বই প্রকাশ করা, পাঠকদের সামনে মেলে ধরা- এই দায়িত্ব নেওয়ার জন্য একটা গিল্ড প্রতিষ্ঠা করা দরকার। সেই গিল্ডের মধ্য দিয়ে সারা বছর প্রচার করা এগুলো তো প্রকাশকেরা করেন না। বা লেখকদের কাছেই প্রকাশকদের কী প্রত্যাশা! লেখকেরাও কী পাণ্ডুলিপি দিতে চাইছেন না নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ছাড়া। তাদের কাছ থেকেই আসুক এই অভিযোগ। আমার তো মনে হয় না এই অভিযোগ ঠিক। একজন লেখক প্রকাশিত হতে চান যত দ্রুত সম্ভব। কাজেই প্রকাশকের সহযোগিতা পেলে লেখকেরা যেকোনো মাসেই তার পাণ্ডুলিপি দেবেন। এক্ষেত্রে প্রকাশকদেরই ভাবা উচিত। তবে হ্যাঁ ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষার মাস, ভাষা আন্দোলনের মাস। রক্ত ঝরানো ভাষা আন্দোলনের পথ পেরিয়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কাজেই ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে মেলা হচ্ছে সেটা একটা আলাদা ব্যাপার।

 

সাইফ বরকতুল্লাহ : প্রত্যেক বছরই বইমেলায় প্রায় কয়েক হাজার বই বের হয়। সমালোচনা থাকলেও এর মাঝেই কিন্তু অনেক লেখক বের হয়ে আসছেন। অনেক নবীন লেখক ভালো লিখছেন। তারপরও অভিযোগ ওঠে, অধিকাংশ বই সম্পাদনা ছাড়াই বের হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের পথটা কী? রফিকুর রশীদ : উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এ নিয়ে গবেষণা করা দরকার। বাংলা একাডেমিকে বলা হয় আমাদের জাতীয় মননের প্রতীক। সেখান থেকে এটা দেখভাল করার কিংবা এডিট করার ব্যবস্থা তো নেই। আমাদের একটা প্রকাশনা অধ্যাদেশ আছে, সেই অধ্যাদেশও ফলো করা হয় না। যার পয়সা আছে, আজকাল প্রকাশনা মাধ্যম সহজ হয়ে গেছে। ফলে বই ছেপে লেখক হচ্ছেন। এত সহজ হওয়া উচিত নয় লেখক হওয়ার ব্যাপারটা। বইয়ের মান দেখভাল করার জন্য একটা জায়গা (প্রতিষ্ঠান) থাকা উচিত জাতীয়ভাবে। সেটা এখনো দাঁড়ায়নি। আজকাল একটা বিষয় বেদনার সঙ্গে লক্ষ করছি, শিশুসাহিত্য আমাদের এখানে একটু চলে ভালো। অভিভাবকেরা ছেলে-মেয়েদর সাথে এনে দুটো রঙিন মলাটের বই কিনে দেন। এটা ভালো। কিন্তু এটার সাথে বাণিজ্য বুদ্ধি যুক্ত হয়ে যেনতেন বই রঙিন করে ছেপে বাজারে নিয়ে আসা হচ্ছে। ছেলে-মেয়েদের হাতে কোয়ালিটি বই যাচ্ছে না। আমি বাংলা একাডেমি কিংবা শিশু একাডেমীর কাছে দাবি জানাচ্ছি- এ বিষয়টা দেখভাল করার জন্য। সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনি তো দীর্ঘদিন ধরেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত। এখন যারা নতুন লিখছেন, বা যারা লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিতে চান বা ভবিষ্যতে তারা একটা জায়গায় যেতে চান- তাদের জন্য আপনার পরামর্শ.. রফিকুর রশীদ : আমার পরামর্শ খুব সহজ এবং একটি। কোনো কাজ সহজে হয় না। কোনো কাজ সংক্ষিপ্ত পথে বড় লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। একজন লেখক হয়ে উঠতে হলে ধৈর্য ধরতে হবে। প্রথমে পড়তে হবে, জানতে হবে, শিখতে হবে। তারপর লিখতে হবে। নিজের লেখা নিজেকেই বাতিল করতে হবে। মূল্যায়ন করতে হবে। যে লেখা নিজে থেকে বাতিল করা যায় না, এত অধিক মমত্ব থাকলে লেখা হয়ে উঠবে না। সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। রফিকুর রশীদ : আপনাকেও। রাইজিংবিডিকে শুভেচ্ছা। রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/সাইফ/এসএন