ফাগুনের মলাট

বইমেলায় আবৃত্তি চত্বর চাই : মাহিদুল

মাহিদুল ইসলাম আবৃত্তিশিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সংগঠক ও প্রশিক্ষক। সম্মিলিত সংস্কৃতিক জোট এবং বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাহসী এক অভিযাত্রিক। স্বরচিত্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। এক যুগের বেশি স্রোত আবৃত্তি ও সংবৃতার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। নাট্যকেন্দ্রের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা একযুগ ধরে। মঞ্চ, বেতার, টেলিভিশন ও অডিও অ্যালবামে উজ্জ্বল উপস্থিতি দুই দশক ধরে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে বুধবার (১৫তম দিন) আসেন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রাইজিংবিডি ডটকমের স্টলে। এ সময় আবৃত্তি, বইমেলা নিয়ে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফ বরকতুল্লাহ। সাইফ বরকতুল্লাহ : দেখতে দেখতে বইমেলার অর্ধেক সময় চলে গেল, কেমন দেখছেন?

মাহিদুল ইসলাম : মেলা বিস্তৃত পরিসর হওয়ায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হওয়ার কারণে মেলায় আসা মানুষ, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ সবার সুবিধা হয়েছে। এ বছর বেশি সুশৃঙ্খল এবং ধুলাবালি মুক্ত পরিবেশটা অনেক সহনীয় মনে হচ্ছে, মানুষ শান্তি পাচ্ছে। সাইফ বরকতুল্লাহ : বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বইমেলা আর অমর একুশে গ্রন্থমলার মধ্যে কোনো পার্থক্য লক্ষ করেছেন?

মাহিদুল ইসলাম : আমাদের বইমেলাকে অনুসরণ করে বিভিন্ন দেশে মেলা হতে পারে। কিন্তু অমর একুশে গ্রন্থমেলার সঙ্গে তুলনা করা যাবে বা সমান্তরালে দাঁড়াতে পারবে এ রকম কোনো মেলা বিশ্বের কোনো প্রান্তে সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। কারণ আমাদের মতো এ রকম আন্দোলন বা আত্মোৎসর্গ কোনো জাতি করেনি। আমাদের এই মেলা শুধুমাত্র কিছু বই কেনা-বেচা বিষয়টা এ রকম নয়। একটি জাতিসত্তার উন্মেষ ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত। এই ইতিহাসের সাথে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যে আবেগ সেটি একটি বিরল ঘটনা। আমি মনে করি আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে বায়ান্নের যে আত্মত্যাগ সেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বইমেলায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতা হচ্ছে, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, শিশুপ্রহর- এগুলোর মাধ্যমে কিন্তু শিশুরা, নতুন প্রজন্ম ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। সাইফ বরকতুল্লাহ : আমরা যারা আবৃত্তির খোঁজখবর রাখি কিংবা আপনি দীর্ঘদিন ধরে আবৃত্তি করছেন, কিন্তু বইমেলায় আবৃত্তি চত্বর নেই- এ নিয়ে কিছু বলবেন?

মাহিদুল ইসলাম : আমার কাছে আবৃত্তির অসংখ্য স্রোতারা বিষয়টি জানতে চায়। গ্রন্থমেলায় কেন আবৃত্তি চত্বর নেই, বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ কেন বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে বিষয়টি আমার কাছে বোধগম্য নয়। মূলধারার প্রকাশনীর স্টলগুলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, আর বাংলা একাডেমি চত্বরে বিভিন্ন সংগঠনের স্টল, এমনকি সরকারি, বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের বড় বড় স্টল রয়েছ। অনেক স্টল রয়েছে যাদের এখানে কোনো উপযোগিতাও নেই, অপরিহার্যতাও নেই। সেখানে বাংলা একাডেমি কেন আবৃত্তি সংগঠনের স্টল নিয়ে ভাবছে না- আমার বোধগম্য নয়। স্টল থাকলে ভালো হতো, গ্রন্থমেলার শ্রী বৃদ্ধি পেত। বাংলাদেশে যত রকম সংগঠন চর্চা রয়েছে, তার ভেতরে আবৃত্তি চর্চা সংগঠন কিন্তু সবচেয়ে উঁচু ও ওপরের দিকে তার স্থান। বইমেলায় চত্বর না থাকার বিষয়ে আমাদের আবৃত্তি সংগঠনের ব্যর্থতা রয়েছে কি না বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি প্রত্যাশা করি এটি থাকলে ভালো হতো। যদি বলা হয় শব্দদূষণের কথা, তাহলে শব্দহীনভাবেও তো প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকতে পারে। ডিজিটাল ভার্সন তো থাকছে বিভিন্ন বইয়ের, কাব্যের। আবৃত্তি তো কবিতার একটা ডিজিটাল ভার্সন। তাহলে আবৃত্তি সংগঠনের স্টল বা চত্বর কেন থাকবে না এটাও আমার কাছে বড় প্রশ্ন।

সাইফ বরকতুল্লাহ : বইমেলায় আবৃত্তির কবিতা নিয়ে অনেক সংকলন বের হয়। কিন্তু আবৃত্তি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ, ভালো বই দরকার- যা পাওয়া যাচ্ছে না?

মাহিদুল ইসলাম : আবৃত্তি নিয়ে বই লিখতে গেলে অনেক সাধনা, চর্চার প্রয়োজন। আমি নিজে আবৃত্তি শিখেছি, সেখানে বড় একটি অনুসঙ্গ আমার আগের যেসব দক্ষ আবৃত্তিশিল্পী রয়েছেন তাদের লেখা প্রবন্ধ আমাকে সহযোগিতা করেছে। এসব বই লেখা আসলে অনেক কঠিন। ‘আবৃত্তি নিমৃতি’ নামে আমি একটি বই লিখেছি আবৃত্তি প্রশিক্ষণের জন্য। এই বইটি লিখতে প্রায় ১৮ বছর সময় লেগেছে। সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনি আবৃত্তির পাশাপাশি একজন সংগঠক। ঢাকার বাইরে এখন কিছু কিছু আবৃত্তি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে। আবৃত্তিশিল্পকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে আর কী কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?

মাহিদুল ইসলাম : যেহেতু এটা প্রয়োগ শিল্প, অন্য সংগঠনগুলোর মতো নয়। এখানে যেহেতু সরাসরি পারফর্ম করতে হয়, তাই শুধু সংগঠন তৈরি করলেই হবে না-  প্রশিক্ষিত করতে হবে। প্রশিক্ষক তৈরি করতে হবে। ৪০০ আবৃত্তি সংগঠনের জন্য তো ৪০০ প্রশিক্ষক নেই। সাইফ বরকতুল্লাহ : শাহবাগ বা টিএসসিকেন্দ্রিক যে আবৃত্তি সংগঠনগুলো রয়েছে, এখানে বিভিন্ন কোর্স হয়। দেখা যায় এসব কোর্সে অনেক প্রশিক্ষণার্থী আসলে কোর্স শেষে আবৃত্তিশিল্পের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখে না- আপনার ভাবনা?

মাহিদুল ইসলাম : আশির দশকে বা নব্বইয়ের দশকে আবৃত্তির কোর্সগুলো ফি মুক্ত ছিল। তখন যারা আবৃত্তি শিখতে চাইত তারাই আসত। এখন কোর্স ফি যুক্ত হয়েছে। প্রচুর মানুষ আসছে। সুতরাং সংগঠনগুলো মনে করে এই ফির মাধ্যমে আবৃত্তি সংগঠনগুলোর পরিধিও বাড়বে। এর সাথে যুক্ত করে দিচ্ছে সংবাদ পাঠ, উপস্থাপনা। এতে ভ্রান্ত হয়ে আরো কিছু মানুষ এখানে আসছে, তারা তো আবৃত্তি শিখতে আসছে না। অনেকেই শুদ্ধ উচ্চারণ শিখতে আসছে। তারা গিয়ে পরে অন্য মাধ্যমে কাজ করছে। কেউ অভিনয়শিল্পী, কেউ সংবাদ পাঠক। আয়োজক তখন চিনতে পারছে না আবৃত্তির জন্য কে মৌলিক মানুষ। এতে সংকট তৈরি হচ্ছে আবৃত্তিশিল্পে। আবৃত্তি প্রশিক্ষণ শুধুই আবৃত্তি প্রশিক্ষণ, আর সংবাদ পাঠ সেটির আলাদা প্রশিক্ষণ হওয়া উচিত। সাইফ বরকতুল্লাহ : আবৃত্তিশিল্পী না হলে কী হতেন?

মাহিদুল ইসলাম : আবৃত্তিশিল্পী না হলে তো কতকিছুই হতে পারতাম। তাহলে তো প্রথমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ঢাকা শহরে ট্রাফিকের কাজ করতাম। কিছু মানুষ অন্তত স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারত। সাইফ বরকতুল্লাহ : বইমেলা নিয়ে আপনার প্রত্যাশা?

মাহিদুল ইসলাম : আমি প্রতিদিন একটি টেলিভিশনের পক্ষে বইমেলা নিয়ে একটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করি। সেখানে বই নিয়ে অসংখ্য লেখকের সঙ্গে কথা বলতে হয়, বই পড়তে হয়। তরুণ লেখকদের সংখ্যাই বেশি। তার মধ্যে কবিতার বইয়ের সংখ্যা বেশি। কিন্তু সংখ্যার বিচারে মান ততটা উন্নত নয়। তাই সংখ্যা নয় বইয়ের মানের দিকে নজর দিতে হবে। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/সাইফ/এসএন