ফাগুনের মলাট

উপন্যাসে ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি দেখাতে চেয়েছি : স্বকৃত নোমান

স্বকৃত নোমান। ঔপন্যাসিক। প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা সাত। এবারের মেলায় প্রকাশিত হয়েছে ‘শেষ জাহাজের আদমেরা’ উপন্যাস। পাশাপাশি লিখছেন গল্পও। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ দুটি। উপন্যাসের জন্য ভূষিত হয়েছেন একাধিক পুরস্কারে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সাইফ বরকতুল্লাহ সাইফ বরকতুল্লাহ : বইমেলা কেমন দেখছেন? স্বকৃত নোমান : গত বেশ কয়েক বছরের তুলনায় এবারের বইমেলা ভালো হচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থানান্তরের পর এই প্রথম একটি গোছানো মেলা উপহার দিতে পেরেছে বাংলা একাডেমি। এবারের নতুন সংযোজন ‘নতুন বই প্রদর্শনী কেন্দ্র।’ একাডেমির বর্ধমান হাউজের সামনে এমন একটি স্টল রয়েছে। প্রতিদিন যে বইগুলো প্রকাশিত হয় সেগুলোর একটি করে কপি এই স্টলে প্রদর্শনের জন্য রাখা হচ্ছে। উদ্যোগটি ভালো। এ ছাড়া মেলার শুরুর দিকে শুক্র-শনি দুদিন সরকারি ছুটি ছিল বলে শুরু থেকেই মেলা জমে ওঠে। পাঠক-দর্শকরা এসেছেন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও সন্তোষজনক। আশা করি ভালোভাবেই শেষ হবে। তবে মেলায় আরো কিছু বিষয় সংযোজন করা দরকার। শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্ত্বর পর্যন্ত এক কাপ চা খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। চা দোকানগুলো উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাঙালি চা-প্রেমী। লেখকদের চা ছাড়া চলে না। সোহারাওয়ার্দী উদ্যানের কোথাও দু-একটা চায়ের স্টল থাকলে খুব ভালো হতো। আশা করি আগামি মেলায় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ভাববে। সাইফ বরকতুল্লাহ : এবারে প্রকাশিত বই সম্পর্কে জানতে চাই। স্বকৃত নোমান : এবার অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে ‘শেষ জাহাজের আদমেরা’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। মানবপাচার নিয়ে উপন্যাসটি গত দুই বছর ধরে লেখা। জার্মান দার্শনিক হেগেল বলেছিলেন, ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে।’ তার বক্তব্য কিছুটা খণ্ডন করে কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘ইতিহাস আপনা থেকে পুনরাবৃত্ত হয়। তবে প্রথমবার যদি তা ট্র্যাজেডি, দ্বিতীয়বার তা হয় প্রহসন।’ আমার প্রশ্ন, ট্র্যাজেডির ইতিহাস কি পুনরাবৃত্তিতে ট্র্যাজেডি হতে পারে না? পারে। কীভাবে পারে তা-ই দেখাতে চেয়েছি উপন্যাসটিতে। চারশ বছর আগে মগ-ফিরিঙ্গি হার্মাদরা বাংলার উপকূল থেকে মানুষদের অপহরণ করে নিয়ে যেত। দাস হিসেবে বিক্রি করে দিত আরাকান ও দাক্ষিণাত্যের বন্দরে বন্দরে ইংরেজ, ফরাসী এবং ওলান্দাজ বণিকদের কাছে। এটা বাংলার ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি। চারশ বছর পর প্রায় একই ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি ঘটল। এই ট্র্যাজেডি হচ্ছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার। সমুদ্রপথে এ মানবপাচার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত একটি ঘটনা। পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়াগামী বহু বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় পথেই মারা যায়। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আবিষ্কার হয় মালয়েশিয়া গমণেচ্ছুদের বহু গণকবর। মানবপাচারের এই মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করেই লিখেছি উপন্যাসটি। দেখাতে চেয়েছি এটা যে ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি। প্রকাশক জানিয়েছেন বইটি ভালোই বিক্রি হচ্ছে। প্রথম এডিশনে পাঁচশ কপি ছেপেছে। এক বছরে পাঁচশ কপি বিক্রি হলেই আমি খুশি। আমার তো খুব বেশি পাঠক নেই। সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনি তো উপন্যাস লিখছেন। আপনার গল্পভাবনা সম্পর্কে জানতে চাই। স্বকৃত নোমান : আপনি জানেন যে, আমার শুরুটা উপন্যাস দিয়েই। প্রথম প্রকাশিত বইটি ছিল উপন্যাস। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পরবর্তী পাঁচ বছর গল্পের প্রতি মনোযোগী ছিলাম না, মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল উপন্যাস। আমার মতে, শিল্পের যত শাখা আছে তন্মধ্যে উপন্যাস এমন একটা জটিল বিষয়, লেখককে উপন্যাসটি লেখা ছাড়া আর কোনো কাজ করার সময় দেয় না। তাকে উপন্যাসের চরিত্রগুলো নিয়েই থাকতে হয়। চরিত্রগুলোই তার নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে ওঠে। সেসব চরিত্রকে একপাশে রেখে গল্পের জন্য নতুন কোনো চরিত্র নির্মাণ করতে গেলে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর বিদ্রোহ করার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বিদ্রোহ করেও। ঔপন্যাসিককে তারা ছেড়ে যায়। কলাকৌশল করে তাদের আবার ফিরিয়ে আনতে হয়। ফলে উপন্যাস লেখার গতি হৃাস পায়। মূলত এই কারণেই আমি ঐ পাঁচ বছর গল্পের দিকে যাইনি। পাঁচ বছর উপন্যাস লেখার পাশাপাশি গল্প লেখার প্রস্তুতিও কিন্তু চলছিল। পৃথিবীশ্রেষ্ঠ গল্পকারদের গল্প পড়েছি। গল্প কী, কী তার ব্যাকরণ- ইত্যাদি বোঝার চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়, দেড়-দুইশ পৃষ্ঠার একটা উপন্যাস লেখার চাইতে দশটা গল্প লেখা কিন্তু অনেক কঠিন। কারণ একটা উপন্যাস শুরু করতে হয় একবার, আর দশটা গল্প শুরু করতে হয় দশবার। আমার এই কথার স্বপক্ষে সাক্ষী মানা যেতে পারে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে। ‘দ্য ফ্রাগেন্স অব গোয়াবা’য় তিনি প্রায় এমন মন্তব্যই করেছেন। তার মন্তব্যটি যথার্থ বলেই মনে করি। গল্প-উপন্যাসের শুরুটাই আসল। শুরু করলে শেষ করতে বেশি সময় লাগে না। তা ছাড়া একটা উপন্যাসের আঙ্গিক থাকে এক রকমের, আর দশটা গল্পের আঙ্গিক থাকে দশ রকমের। উপন্যাসের ভাষা কাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, আর গল্পের কাহিনী নিয়ন্ত্রিত হয় ভাষা দ্বারা। একজন গল্পকারের পক্ষে বছরে তিন-চারটির বেশি গল্প লেখা প্রায় কঠিন। এর বেশি হলে সেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার অবকাশ থাকে। আর একজন ঔপন্যাসিকের পক্ষে তো তিনটাও কঠিন। কেন কঠিন সেকথা আগেই বলেছি। উপন্যাস লেখার পাশাপাশি আমি গল্প লেখারও চেষ্টা করছি। দুটো গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। আগামি দিনে আরও গল্প লেখার ইচ্ছে আছে। সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনার উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য বিষয় কী? স্বকৃত নোমান : কোন উপন্যাসের কথা বলব? একেক উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় তো একেক রকম। যেমন লোকপুরাণ নিয়ে লিখেছি ‘রাজনটী’, বাস্তচ্যূত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে লিখেছি ‘বেগানা’, বীর বাঙালি শমসের গাজীকে নিয়ে ‘হীরকডানা’,  সাতক্ষীরা অঞ্চলের সংখ্যালঘু হিন্দুসম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের নীরব দেশত্যাগ ও ধর্মান্তরের ঘটনা নিয়ে লিখেছি ‘কালকেউটের সুখ।’ একেক উপন্যাসে একেক বিষয় প্রধান হয়ে উঠে। তবে হ্যাঁ, লেখার সময় আমি এ দেশ, দেশের মানুষ এবং বাঙালির ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন থাকি। সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনার উপন্যাস লেখার কৌশলটা কী? স্বকৃত নোমান : আমি সময় নিয়ে উপন্যাস লিখি। বিষয়বস্তু ঠিক করার পর বিষয়-সংশ্লিষ্ট পড়ালেখা করি বিস্তর। মাঠপর্যায়ে গিয়ে সংগ্রহ করি তথ্য-উপাত্ত। তারপর একটা আউটলাইন তৈরি করি; যদিও লেখা শুরু করার পর আউটলাইনটা আর ঠিক থাকে না। একেকটি পর্ব লিখে বারবার সম্পাদনা করি। গোটা উপন্যাস লেখা শেষ করার পর দফায় দফায় চলে সম্পাদনা। বইটি যাতে নির্ভুল হয় সেই চেষ্টা থাকে। সাইফ বরকতুল্লাহ : আমরা দেখি যে সমকাল নিয়ে সাহিত্য রচনা কম হচ্ছে। সমকালীন উপন্যাস নিয়ে আপনার ভাবনা কী? স্বকৃত নোমান : সবচেয়ে বেশি কাজ হচ্ছে সমকাল নিয়ে। বর্তমানে যেসব গল্প-উপন্যাস লেখা হচ্ছে তার বেশিরভাগই তো সমকালীন বিষয়বস্তু নিয়ে। হরিশঙ্কর জলদাস, জাকির তালুকদার, আহমাদ মোস্তফা কামাল, শাহনাজ মুন্নী, প্রশান্ত মৃধা, রায়হান রাইন, মোহিত কামাল, পাপড়ি রহমান, উম্মে মুসলিমা, অদিতি ফাল্গুনী, হামিম কামরুল হক প্রমুখ এবং এদের পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই তো সমকালীন বিষয় নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখছেন। আমার বেশিরভাগ উপন্যাসই তো সমকালীন বিষয় নিয়ে লেখা। সুতরাং কম হচ্ছে কথাটা সঠিক বলব না। হ্যাঁ, সমকালীন বিষয় নিয়ে রচিত উপন্যাসগুলো কতটা শিল্পমানসম্পন্ন হচ্ছে- এটা নিয়ে প্রশ্ন হতে পারে এবং এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনাও হতে পারে। সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনি কী মনে করেন সমকালীন বিষয় নিয়ে শিল্পমানসম্পন্ন গল্প-উপন্যাস লেখা হচ্ছে? স্বকৃত নোমান : উপন্যাসের কথা বলতে পারব না, তবে সমকালীন বিষয় নিয়ে অনেক ভালো ভালো গল্প যে লেখা হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আশির দশকের পর এ পর্যন্ত অনেক ভালো গল্প রচিত হয়েছে। বাংলাদেশের গল্প নিয়ে আমি বেশ আশাবাদী। সাইফ বরকতুল্লাহ : লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? স্বকৃত নোমান : গত জানুয়ারির শেষের দিকে একটা উপন্যাস শুরু করেছি। আপাতত নাম দিয়েছি ‘নিস্তব্ধতার সংলাপ।’ নাম পরিবর্তন হতেও পারে। হাজার পাঁচেক শব্দ লেখা হয়েছে। চেষ্টা করব আগামি এক বছরের মধ্যে এটি শেষ করতে। এটি লেখার ফাঁকে ফাঁকে কিছু গল্প লেখার ইচ্ছে আছে। সাইফ বরকতুল্লাহ : আপনাকে ধন্যবাদ। স্বকৃত নোমান : আপনাকেও ধন্যবাদ। রাইজিংবিডির জন্য শুভকামনা। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/সাইফ