ফাগুনের মলাট

কল্পলোকে ক্রিকেটের গল্পে গল্পে ইতিহাস

রুহুল আমিন : অনেককে বলতে শোনা যায় ইতিহাস খুব কাঠখোট্টা একটা বিষয়। ইতিহাসের সাল তারিখ মনে রাখা খুব কঠিন। আর তাও যদি হয় ক্রিকেটের ইতিহাস তাহলে তো কথাই নেই। ক্রিকেটে তো হিসাব আর হিসাব। কিন্তু ক্রিকেটের ইতিহাসও ঝরঝরে হতে পারে যদি লেখকের সেই মুন্সিয়ানা থাকে। কিংবদন্তি ক্রিকেটার ডব্লিউ জি গ্রেস, ক্লেম হিল, ফ্রেড স্পফোর্থ, ভিক্টর ট্রাম্পার, জো ডার্লিং, গিলবার্ট জেসপ, সিবি গ্রেস, চালর্স ব্যানারম্যান, সিবি ফ্রাই, রিচি বেনো, সিডনি বানর্স, উইলফ্রেড রোডস, ডন ব্র্যাডম্যান, জ্যাক হবস ও রনজিতসিংজিদের নিয়ে লেখা বইটির নাম ‘কল্পলোকে ক্রিকেটের গল্প’। বইটি লিখেছেন উৎপল শুভ্র। যদিও বইটি উপন্যাস কিনা তা নিয়ে দ্বিধা আছে। স্বয়ং লেখকই বইয়ের ফ্ল্যাপে এই কথা উল্লেখ করেছেন। ফ্ল্যাপের শুরুটা এমন- ‘উপন্যাস? না। উপন্যাস নয়। ইতিহাস? না। ইতিহাসও নয়। তাহলে?’ এই প্রশ্ন লেখকের মনেই উদয় হয়েছে। অবশ্য লেখক বইটির শেষদিকে গিয়ে এর উত্তরও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আবারও বলছি, এটা উপন্যাস নয়। বড়জোর যা দাবি করা যায়, উপন্যাসের আদলে টেস্ট ক্রিকেটের সেই আদিকাল এবং সেই সময়ের অমর কিছু চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা।’ আসলে কল্পলোকের ক্রিকেটের গল্প বইটা এক অর্থে ক্রিকেট ইতিহাসেরই বই। আবার যেহেতু চরিত্রগুলো চলমান এবং আলাপচারিতায় অংশ নিয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে। তাই উপন্যাস দাবি করলেও দোষের কিছু হবে না। লেখক বইয়ে এক কল্পনার জগৎ তৈরি করেছেন। যে জগতে আবার কিংবদন্তি ক্রিকেটাররা একটি ক্রিকেট ম্যাচও খেলে। টেস্ট ক্রিকেটের শুরু থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বিখ্যাত ক্রিকেটার ও তাদের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে বইটির কাহিনী সাজানো হয়েছে। লেখকের সৃষ্ট জগতে ওই সময়ের কিংবদন্তি ক্রিকেটাররা গল্প আড্ডার ছলে একে একে বলে যান তখনার টেস্ট ক্রিকেটের সব ইতিহাস। সেখানে ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত গল্পও বাদ যায় না। টেস্ট ক্রিকেটের উদ্বোধক থেকে শুরু করে প্রথম রান, প্রথম উইকেট, প্রথম ক্যাচ। এমন করে প্রথম যা কিছু হয়েছে তার ইতিহাস। পড়তে গিয়ে যে কেউ চরিত্রগুলোর গল্প আ্ড্ডার মুড দেখতে পাবে। আবার পাশাপাশি যারা ক্রিকেটের ইতিহাস সম্পর্কে অল্প বিস্তর আগ্রহী তাদের কাছে ইতিহাসটাও ধরে দেবে খুব সহজে। চরিত্রগুলোর কথোপকথন ও ক্রিকেট রেকর্ডগুলো এমনভাবে উপস্থাপন হয়েছে, পড়ার সময় মনেই হবে না এই রেকর্ডগুলো প্রায় দেড়শ বছর আগেকার। ডব্লিউ জি গ্রেস ও আলফ্রেড শ’র কথোপকথন দিয়ে কাহিনী শুরু হয়। তারপর জর্জ লোহ্‌ম্যানের ১৮ টেস্টে ১০.৭৫ বোলিং গড় ও ৩৪.১ স্ট্রাইক রেটে ১১২ ইউকেট নেওয়ার ইতিহাস দিয়ে শুরু হয় ইতিহাসের মূলপর্ব। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা যাওয়া লোহ্‌ম্যানের এই ইতিহাসটা কমপক্ষে ২০০০ বল করেছেন এমন বোলারদের মধ্যে এখনো টিকে আছে তা গল্পের ছলে বলেন ডব্লিউ জি। ক্রিকেটারদের দিয়েই ক্রিকেটের ইতিহাস বলিয়েছেন লেখক। কখনো নিজেরটা নিজে, আবার কখনো অন্যকে দিয়ে। ১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ মেলবোর্নে ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচের প্রথম বলটি করেছিলেন ইংল্যান্ডের ডান হাতি স্লো মিডিয়াম বোলার আলফ্রেড শ। সেই থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত যত রেকর্ড হয়েছে এবং ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট যা কিছু ঘটেছে তার প্রায় সব ওঠে এসেছে কল্পলোকের ক্রিকেটের গল্পে। সেখানে বাদ যায়নি ডব্লিউ জির ডাক্তারি, রনজিতসিংজির মাছ ধরা, অ্যাসেজ সৃষ্টির কাহিনী, তখনকার হার্ডহিটার গিলবার্ট জেসপ ও জর্জ বোনর (যাকে ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতা ও ১১০ কেজি ওজনের জন্য দ্য কলোনিয়াল হারকিউলিস বলা হতো), ছক্কা মানে বাউন্ডারি পার না পুরো মাঠ পার করা, পাঁচ রানের বাউন্ডারি, অ্যালবার্ট ট্রট ও উইলিয়াম স্কটনের আত্মহত্যা, প্রতিপক্ষ দলের হয়ে বদলি ফিল্ডার হিসেবে মাঠে নেমে নিজ দলের ব্যাটসম্যানের ক্যাচ ধরা। তখনকার সময়ে ম্যাচ ফিক্সিং, এক ব্যাটসম্যানের পরপর তিন ইনিংসে ৯৯, ৯৮ ও ৯৭ রানে আউট, খেলোয়াড়ই দলের ম্যানেজার হওয়াসহ ক্রিকেটের টুকিটাকি সব এসেছে বইটিতে। ক্রিকেট ইতিহাসের বাইরে ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত অনেক ঘটনার প্রাসঙ্গিক বর্ণনা রয়েছে বইটিতে। মোট কথা খুব সাবলীল ও ঝরঝরে বর্ণনায় তখনকার দিনের ক্রিকেটের ইতিহাস ও ঘটনা রয়েছে কল্পলোকে ক্রিকেটের গল্পে। বইটির একেবারে শেষে এসে আবির্ভুত হন সড়ক দুর্ঘটায় প্রয়াত বাংলাদেশের ক্রিকেটার মানজারুল ইসলাম রানা। তিনি জানান তিনিই একমাত্র টেস্ট ক্রিকেটার যে সবচেয়ে কম বয়সে ডব্লিউ জি গ্রেসদের সঙ্গে কল্পলোকে যোগ দিয়েছেন। যেহেতু কল্পলোকে ক্রিকেটের গল্প বইটির সময়কাল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। এসেছে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সময়কার ক্রিকেট ইতিহাসও। ভবিষ্যতে যদি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ব্র্যাডম্যানের সময় ও আধুনিক যুগের ক্রিকেটের পটভূমি নিয়ে আরো দু-তিনটি বই আসে এই লেখকের। তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। লেখক যেন সচেতনভাবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ক্রিকেট ইতিহাসে ব্র্যাডম্যান ও রানাকে হাজির করেছেন। ১৩৭৩ সালের ২৫ পৌষ নেত্রকোনায় জনম উৎপল শুভ্রের। পুরকৌশলে স্নাতক করেছেন তিনি। শখ করে ক্রীড়া সাংবাদিকতায় এসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সে শখই পেশা হয়ে গেছে। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্রীড়া সাংবাদিকতা করছেন। পেশাগত জীবনে ক্রিকেট ও ফুটবল বিশ্বকাপ এবং অলিম্পিক গেমসের মতো বড় আসর কাভার করেছেন। অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে বিদেশের পত্রিকা ও ওয়েবসাইটে। বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।  ১৯৯৮ সাল থেকে  ‘ক্রিকেটের বাইবেল’ বলে পরিচিত উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালাম্যানাক-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে আছেন তিনি। এটি তার ১১তম বই। এর আগের তিনি দশটি বই লিখেছেন। বইগুলো হলো- ষোল তারকার মুখোমুখি, সেই সব ইনিংস, ভেজা উইকেটে, কাছের ক্রিকেট দূরের ক্রিকেট, বিশ্ব যখন ফুটবলময়, তারার মুখে তারার কথা, শহর থেকে শহরে, ক্যারিবীয় কড়চা, আপনি কি জানতেন? ও শচীন রূপকথা। সর্বশেষ বই শচীন রূপকথা প্রকাশিত হয়েছিল দুই বছর আগে। বইটি এবারের একুশে বইমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে। ১৪৪ পৃষ্ঠার বইটির দাম ৩০০ টাকা। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/রুহুল/সাইফ