ফাগুনের মলাট

রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে মামলা ও আমাদের বাস্তবতা

জব্বার আল নাঈম: সাহিত্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ছোটগল্প। এর মাধ্যমে লেখক মানব জীবনের সেই অংশ তুলে ধরেন যা শাশ্বত জীবন আর মানবতা বোধের মূর্ত কিংবা বিমূর্ত ছবি। ছোটগল্পকে কোনো সংজ্ঞার নিয়মকানুনে বাঁধা যায় না। এর বিচরণ বহুমাত্রিক। তারপরও এর একটি রূপ তুলে ধরার জন্য আমরা প্রায়ই রবিঠাকুরের ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘বর্ষাযাপন’ কবিতার সেই পঙ্‌ক্তিগুলো স্মরণ করি, যেখানে বলা হয়েছে: ‘ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা ছোটো ছোটো দুঃখ কথা নিতান্তই সহজ সরল- সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি, তারি দু-চারিটি অশ্রুজল। নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ- অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে শেষ হয়ে হইল না শেষ।’ ‘রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে মামলা ও বিবিধ গল্প’ নাম দেখেই বোঝা যায় এর ভেতর আছে তীব্র রকমের ক্ষোভ, আছে শ্লেষ, আছে রাষ্ট্রকে অতিক্রম করে আরো বড় কিছু হওয়ার অথবা ভাবার তীব্র আকাঙ্খা। আসলেই কি তাই? মোটেও না। ‘রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে মামলা ও বিবিধ গল্প’ গ্রন্থে আশরাফ জুয়েল গল্প বলতে চেয়েছেন এবং গল্প বলেছেন। গল্পের ভেতরে গল্প নির্মাণ করেছেন অনিন্দ্য সুন্দর বাস্তবে। কারণ, সুন্দর আমাদের অহংকার, সুন্দর আমাদের অলংকার। সুন্দরের বিনির্মাণ বারবারই আমাদের বিনোদন দেয়। আশরাফ জুয়েল শব্দের পেছনে শব্দ নয়, শব্দ নিয়ে খেলা করেছেন, খেলতে খেলতে আমাদের নিয়ে যেতে পেরেছেন রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে। সেখানে নিয়ে শুনিয়েছেন বিবিধ গল্প। যে গল্প বস্তিবাসীর, যেখানে মানুষরূপে কুকুরের প্রত্যাবর্তন দেখি, পতিতার নানান চরিত্র দেখি, চরিত্রের ভেতরে পাই এক বেদনাময় কাব্যদৃশ্য। আশরাফ জুয়েল এমন রাষ্ট্র চাননি, যেখানে একজন পতিতার স্থান হবে না। আবার এও বলতে চেয়েছেন- নিজেকে বাঁচানোর জন্য নারী কেনো পতিতাবৃত্তি করবে? এর দায়ভার সম্পূর্ণ  রাষ্ট্রের। ‘রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে মামলা’ বাক্যটি খুব সহজ নয়। অসাধারণ উচ্চারণ। আশরাফ এ কথা বলতে পেরেছেন, কারণ তিনি কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে দেখেছেন, বোমার আঘাতে ঝলসে যাওয়া মায়ের মুখ। ঝলসানো মুখ দেখে রাষ্ট্র যখন হাসে অসহায় সন্তান বিচারের জন্য আদালতে না গিয়ে গতানুগতিক ধারণার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এটা আশরাফ জুয়েলের জায়গায় অন্য কেউ হলেও অজান্তে সেই ক্ষোভ প্রকাশ করতেন, আর তা মিশে যেতো প্রবাহমান বাতাসের স্রোতে। 'জাড়' গল্পে আমরা দেখতে পাই ক্ষমতার লোভে সন্তান বাবাকে খুন করার সমস্ত পরিকল্পনা করে চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসতে চায়। সমাজের অলিগলিতে লুকিয়ে থাকা ঘটনা ও গল্প আশরাফ জুয়েল তাঁর মেধা, শ্রম, যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে শৈল্পিক এক অবয়ব তৈরি করতে পেরেছেন। তিনি দেখাতে পেরেছেন রাষ্ট্রের হাত-পা নেই, অথচ রাষ্ট্র আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্রের মুখ নেই, অথচ রাষ্ট্র আমাদের কড়া কথা শোনায়। রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই, অথচ রাষ্ট্র আমাদের সামনে দৃশ্যমান দৃশ্যে নিয়ম দাঁড় করায়। মোদ্দা কথা, রাষ্ট্র এক আজব যন্ত্র। যে যন্ত্রের যাতাকলে তৈরি হয় বোমা আর ককটেল। ককটেলে পুড়ে যায় মায়ের মুখ! অথচ থাকতে হয় নির্বাক! এমন মুহূর্তে একজন লেখক কলম ছাড়া আর কোথায় আশ্রয় খুঁজতে পারেন! আশরাফ জুয়েল তার ব্যতিক্রম নন। তিনি কলমকে কথা শোনাতে পেরেছেন, এবং হেঁটে চলছেন আঁধারের পথে আলো হাতে। সেই আলো হয়ত সমসাময়িক সময়ে অনেকের চোখে দৃশ্যগত হবে না, কিন্তু আগামী দিনের পথ চলতে গেলে পাঠক আশরাফ জুয়েলের রাষ্ট্রধারণার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করবে। আশরাফ জুয়েলের গল্পে সমকালীন বাস্তবতা, দেশভাগ, ব্যক্তিক অপ্রাপ্তি, রাজনৈতিক স্খলন— সবকিছুই উঠে এসেছে। তিনি যে রূপায়ণে এ প্রসঙ্গকে ছোটগল্পে চিত্রিত করেছেন তা সদর্থক। জীবন কখনো একক দুঃখের কিংবা একক সুখের সমষ্টি নয়, নিরবচ্ছিন্ন দুঃখময় জীবনেও সুখের আভাস বিদ্যমান। তাঁর গল্পের ভূমিতে থোকা থোকা কষ্ট ফুটে থাকে, দুঃখের বিদীর্ণ প্রান্তর তাঁর গল্পভূমি, দুঃসহ জীবনের রেখাপাত তাঁর একেকটি সৃষ্টি, সেই দুঃখসমুদ্র থেকে তিনি তুলে আনেন বিন্দু বিন্দু সুখের ছটা। সেই সুখের উদ্ভাস তিনি গল্পের পরিণতিতে এমনভাবে তুলির আঁচড়ে এঁকে দেন, যা পাঠকচিত্ত জয় করতে কালবিলম্ব হয় না। যে কথা এখনও বলা হয়নি, তা হলো নিরীক্ষাপ্রবণতা। গল্পকার তাঁর প্রতিটি গল্পে নিরীক্ষা করার চেষ্টা করেছেন এবং প্রায় অনেকাংশে সফল হয়েছেন। ‘রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে মামলা ও বিবিধ গল্প’ বইটিতে মোট ১২টি গল্প রয়েছে। প্রচ্ছদ এঁকেছেন মাসুক হেলাল। প্রকাশক কাগজ প্রকাশন। মূল্য ২০০ টাকা। উল্লেখ্য এই গল্পগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি  জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৭-এ ভূষিত হয়েছে। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা