অন্য দুনিয়া

মাটি খুঁড়লেই গুপ্তধন!

নওগাঁ প্রতিনিধি : নওগাঁর পোরশার মাটি যেন সোনার চেয়েও খাঁটি। অমূলক এ কথাটির প্রমান মিলেছে উপজেলার নিতপুর ইউনিয়নের পশ্চিম রঘুনাথপুর (টেকঠা) গ্রামের পরেই পূর্ণভবা নদীতে।

 

নদীর পূর্ব পাড় প্রায় তিন কিলোমিটারের মধ্যে যে কোনো স্থানে খনন করলেই মিলছে নানা প্রকার মূল্যবান পাথর। আর এভাবে দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে পরিবারের সকল সদস্য মিলে মাটি খনন করছেন এলাকার অনেকই।

 

সকাল হলেই কোদাল কাঁধে নিয়ে ছুটে যান সেখানে। মাটি খনন করলেই পাওয়া যাচ্ছে ছোট-বড় অনেক রকমের পাথরসহ অত্যন্ত মূলবান জিনিস।

 

যেসব বস্তু এখানে মিলছে তারমধ্যে সোনার চেন, পয়সা, তাবিজ, তসবি, ছোট আকারের বল এবং নানা বর্ণের পাথর উল্লেখযোগ্য। এগুলোর একেকটির রং একেক রকম। কোনটা লাল, কালো, সাদা, কমলা, সবুজ আবার কিছু গোলাপী রঙের মতো দেখা যায়।

 

তাই প্রতিদিন প্রায় এক থেকে দেড়শ’ মানুষ মাটি খনন করেন সেখানে। মজার বিষয় হলো- এখানে ছোট কিংবা বড় যে কোনো পাথর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ক্রেতারা সেখানে উপস্থিত থাকেন সর্বদাই। একেকটি পাথর আনুমানিক ১০ গ্রাম হলে প্রায় ১৫ হাজার টাকা করে দাম মিলছে।

 

স্থানীয়রা বলছেন, এখানে সর্বোচ্চ প্রায় ৮৫ হাজার টাকা দামের তসবি/পাথর পাওয়া গেছে। তাই নিজস্ব এলাকা ছাড়াও দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এসে সমসাময়িকের জন্য মৌখিক পাঁচ বা ১০ শতক করে জমি কিনে খনন প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন।

 

বিষয়টি লোকমুখে জানাজানি হলে, জায়গাটি পরিদর্শন করেন স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। তবে, এটি আজ নতুন নয়। দীর্ঘদিন থেকেই সেখানকার চাষীরা জমি চাষ করার সময় ছোট বড় অনেক কিছুই পেয়ে থাকেন বলে জানা গেছে।

 

এ বিষয়ে কথা হয় পাশের গ্রামের ৯০ বছর বয়সী মো. হুমায়ূন রেজার সঙ্গে। তিনি জানান, প্রায় ৬৫০বছর আগের কথা। ইতিহাসে পাওয়া যায় সম্রাট শের শাহ্র আমলে সমগ্র ভারত বর্ষ ৪৭টি পরগণায় বিভক্ত ছিল।

 

তার মধ্যে একটি পরগণা হলো পোরশার পাশের থানা গোমস্তাপুরের রোকনপুর।পরে সম্রাট শাহজাহানের ছেলে সুজাউদ্দীনের (সুজা) আমলে সুদূর রাজমহল থেকে রোকনপুর পর্যন্ত সামুদ্রিক এলাকা ছিল।

তখন বাংলার সুবাদার ছিলেন সুজা। সে সময়ে নৌকা বা জাহাজে করে বহু মালামাল এখানে আমদানি ও রফতানী হতো।

 

সম্প্রতি যে নদীর পাশের এলাকায় মূল্যবান সামগ্রী উঠছে, ঠিক সেই জায়গায় হিন্দুদের কালির মন্দির ছিল। যার প্রমাণ স্বরূপ কালিদহ বলে একটি কূপ আজও বিদ্যমান আছে নদীতে।

 

সেখানে তারা ‘কালি মায়ের’ মূর্তি বিসর্জন দিতেন। ইতিহাসে দেখা যায় সে সময়কার হিন্দুরা তাদের ধন-রত্নসহ মূল্যবান সামগ্রী মন্দিরে গচ্ছিত রাখতেন।

 

১৯৪৯ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে সে সময়ের ধনীক শ্রেণির হিন্দুরা সবাই ভারতে পলায়ন করে। এ ছাড়াও টেকঠা-পূর্ণভবা নদী থেকে প্রায় বিশ মাইল ভিতরে বাংলার সাবেক রাজধানী গৌড় নামক স্থানটি ছিল রাজাদের আশ্রয়স্থল।

 

এর অদূরে মালদা জেলায় অবস্থিত বড় সোনা মসজিদ। যার প্রমান আজও দেখা যায় রকনপুর বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন একটি বিরাট আকৃতির চেরাগদান।

 

অনেকেই বলেন, এর ভিতরে শত শত লিটার তৈল দিয়ে মশাল জ্বালানো হতো। এতে করে জাহাজের নাবিকদের দিক নির্ণয়ে কোনো ভ্রষ্টতা ঘটত না।

 

এরকম আরেকটি আশ্চর্য চেরাগদান দেখা যায় সাপাহার উপজেলার দিবরদিঘী নামক স্থানে। আরও দেখা যায় পোরশা উপজেলার বিষ্ণপুরে (বেড়াচৌকি)। সেখানে পাল বংশীয় রাজা দেবপালের দূর্গ ছিল। এর প্রমাণ মেলে বেড়াচৌকির চারিদিকের খনন দেখে এবং সেখানে নদীর মতো পানিও জমে থাকে সারা বছর। পাশাপাশি ছোট নদী জনিত দুটি নালা এখনও আছে।

 

সেই আমলে এর গভীরতাও ছিল অনেক। সে সময়ে সৈন্যদের পাহারায় রাখা হতো পুকুরের চর্তুদিকে। এর উত্তর তোরণদ্বারে দুটি ভুজালি ছিল। যা অনেকেই দেখেছিলেন।

 

সর্বোপরি বলা যায় এই এলাকাটি ছিল ধনীক শ্রেণির হিন্দু ও রাজ-রাজড়াদের আশ্রয়স্থল। কাজেই বহু মূল্যবান ধন-রত্ন মাটির নিচে পড়ে থাকা অসম্ভব কিছু নয়।   

     

রাইজিংবিডি/নওগাঁ/৮ ডিসেম্বর ২০১৫/লোকমান আলী/সনি