অন্য দুনিয়া

সোহাগপুর গণহত্যা দিবস

শাকিল আহমেদশেরপুর, ২৫ জুলাই :  আজ ২৫ জুলাই। সোহাগপুর গণহত্যা দিবস।

১৯৭১ সালের এই দিনে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে পাক হানাদার বাহিনী চালায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।

পাখির মত নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে ১শ ৮৭ জন নিরীহ পুরুষ ও শিশুকে।

সেদিনের সেই হত্যাযজ্ঞ নিঃসন্দেহে এক বর্বরোচিত ‘গণহত্যা’ যার বেদনাদায়ক স্মৃতি কথা আমাদের অনেকেরই জানা নেই।

স্বাধীনাতার পর পুরুষ শূন্য ওই গ্রামটিকে নাম হয় ‘বিধবা পল্লী’। ৪২ বছর যাবত বুকে পাথর সমান কষ্ট চেপে স্বামী ও সন্তান হারা ওই বিধবা পল্লীতেই কালের সাক্ষী হয়ে আজো বেচেঁ আছেন ৩৪ বিধবা।

তাদের এখন দাবি একটিই স্বামী সন্তানদের হত্যার মূলে যারা ছিল সেই রাজাকার ও মানবতা বিরোধী অপরাধের নায়কদের বিচার। সেই সঙ্গে জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত কারো কাছে হাত না পেতে নিজেদের উপার্জনে দু’মুঠো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার।

শেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে নালিতাবাড়ি উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রাম। ৭১’র ২৫ জুলাই সোহাগপুর গ্রামের মানুষের জন্য বীভৎস একটি দিন।

ওই দিন সকাল ৭টায় সোহাগপুরবাসীর উপর নেমে এসেছিল পাক বাহিনী ও রাজাকারদের আকস্মিক এবং নারকীয় নির্যাতন ও গণহত্যা।

সোহাগপুর গ্রামে কোন মুক্তিযোদ্ধা ছিলনা। তবে পাশ্ববর্তী গ্রাম বারুয়াজানীর ঘরে ঘরে ছিল মুক্তিযোদ্ধা। তাই ওই গ্রামবাসী কখনো ভাবেনি পাকবাহিনী দ্বারা তারা আক্রান্ত হবে। অনেকটা শান্তিতে দিন যাচ্ছিল তাদের। কিন্তু ২৫ জুলাই সকালে যখন গ্রামবাসী আমন ধান রোপনের কাজে ব্যাস্ত ছিল ঠিক তখন ওই দিকে ব্যস্ত ছিল পাক বাহিনী আর রাজকার বাহিনীরা।

স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাক বাহিনী গ্রামটির তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে, ঠিক পলো দিয়ে মাছ ধরার মতো। কেউ কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই যাকে যেভাবে পেয়েছে সেখানেই নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছ। এখানেই শেষে নয়, বর্বর হানাদার বাহিনীর দলকে দেখে নিরীহ গ্রামবাসী যখন ঘরে এসে আত্মগোপন করছিল তাদের সে ঘর থেকেই বের করে স্ত্রী সন্তানদের সামনেই পাখির মতো গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মম নির্যাতনের মধ্য দিয়ে হত্যা করা হয় ১৮৭ জন নীরিহ মানুষকে।

শিশু -পুরুষ কেউই রেহাই পায়নি এ হত্যাযজ্ঞ থেকে।  এই ভয়াবহতায় এবং নিষ্ঠুরতায় নির্বাক হয়ে গিয়েছিল গায়ের মানুষসহ পশু-পাখি সবাই। পাক বাহিনী গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে গ্রামবাসী ধীরে ধীরে ফিরে আসে। এখানে সেখানে পরে থাকা লাশ মশারি, শাড়ি, কলাপাতা পেঁচিয়ে কোন মতে মাটি চাপা দিয়ে রাখে।

এক সময় দেশ স্বাধীন হয়। স্বামীহারা ওইসব পরিবারের শুরু হয় কঠিন জীবন সংগাম। পুরুষ শূন্য এ গ্রামটির নাম করণ করা হয় ‘বিধবা পল্লী’।

বর্তমানে এ বিধবা পল্লীতেই কালের সাক্ষী হয়ে বেচেঁ আছেন ৩৪ জন বিধবা। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী সর্ব প্রথম তার নিজ তহবিল থেকে সাহায্যের হাত বাড়ান। ওই সময় প্রতিজনকে ২টি করে ছাগল, শাড়ি, চাউল ও ডালসহ ব্র্যাকের সহযোগীতায় ১২০০ টাকা করে আমরণ ভাতা প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর অজ্ঞাত কারণে সব সুযোগ সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্থানীয় সাংবাদিকদের লেখনির মাধ্যমে নজরে পরে যৌথ বাহিনী ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্দোগে কৃষি সমন্বয়ক পাওয়ারটিলার, মাশরুম ও বনায়নসহ তিনটি প্রকল্প চালু করা হলেও তা পরবর্তিতে সঠিক তদারকির অভাবে স্থবির হয়ে যায়।

বর্তমানে ওই প্রকল্পের ঘর ভেঙ্গে যাওয়ায় কৃষি উপকরণের বিভিন্ন মেশিন ও যন্ত্রাংশ খোলা আকাশের নিচে পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

এরপর সর্বশেষ ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর ওই সোহাগপুর বিধবা পল্লিতে স্থানীয় এমপি ও কৃষি মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর সহযোগীতায় ৬১ জন বিধবা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের মাঝে ভাতা প্রদান করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ড. আতিউর রহমান।

এ সময় ট্রাস্ট ব্যাংকের সহায়তায় ৩৭ জন বিধবাকে আজীবন ১ হাজার টাকা করে ভাতা এবং বাকি ২৪ জন শহীদ পরিবারকে ৫ বছর পর্যন্ত ১ হাজার টাকা করে ভাতা প্রদান করা হয়।

সেই সঙ্গে ৬১ জন বিধবা ও শহীদ পরিবার সদস্যদের মাঝে এককালীন আরো ৭ হাজার টাকা এবং প্রত্যেককে একটি করে শীতের চাঁদর ও সোলার চার্জার বাতি দেয়া হয়।

তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর দেয়া প্রকল্প গুলো চালু থাকাবস্থায় বিধবারা একটু ভালো ছিল, তাই তারা ওই প্রকল্পটি পুনরাই চালু করে এর সঠিক তদারকির জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও সরকাররে প্রতি দাবি জানিয়েছে।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যেন স্বামী-সন্তানের শোক বুকে চেপে একটু ভাল-মন্দ খেয়ে, পড়ে বেচেঁ থাকতে পারে এটাই একমাত্র চাওয়া সোহাগপুর বিধবা  পল্লীর বিধবাদের ।

 

 

রাইজিংবিডি/ এমএএস