সাতসতেরো

স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়েছিলেন তিনি

শাহ মতিন টিপু : রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, কমরেড অনেক পরিচয়ে পরিচিত তিনি। তাকে বলা হয় বিপ্লবী রাজনীতিবিদ। সংবাদপত্রে তার লেখা কলাম ছিল বেশ পাঠক প্রিয়। শুধুমাত্র কলামনিষ্ট হিসাবেই তিনি সর্বমহলে আলাদা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলেন। তার কলাম `স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই` বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো। পুরো নাম নির্মল কুমার সেন গুপ্ত কিন্তু নির্মল সেন নামেই সবার কাছে পরিচিত হয়েছিলেন। বিখ্যাত হয়েছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নির্মল সেনের ছিল সু-সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধু তাকে সেন মশাই বলে সম্বোধন করতেন।

 

নির্মল সেনের ৮৫তম জন্মদিন আজ। তার জন্ম গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার দিঘিরপাড় গ্রামে ১৯৩০ সালের ৩ আগস্ট। পিতার নাম সুরেন্দ্র নাথ সেন গুপ্ত ও মাতার নাম লাবণ্য প্রভা সেন গুপ্ত। পরিবারের ছয় ভাই ও বোনের মধ্যে নির্মল সেন ছিলেন চতুর্থ। পিতা কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনের গণিত শিক্ষক ছিলেন। ১৯৪৬ সালে ভারত বিভাগের ঠিক পূর্বে তার পুরো পরিবার বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে গেলেও তিনি এ দেশেই থেকে যান। তিনি বড় হয়েছেন ঝালকাঠি জেলায় তার পিসির বাড়িতে। তিনি ঝালকাঠির কলসকাঠি বিএম একাডেমি থেকে ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে আইএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ও মাস্টার্স পাস করেন। নির্মল সেনের জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

স্কুল জীবনে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মাধ্যমে নির্মল সেনের রাজনৈতিক জীবন শুরু। কলেজ জীবনে তিনি অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রাজনীতি করতে গিয়ে নির্মল সেনকে জীবনের অনেকটা সময় জেলে কাটাতে হয়েছে।

 

নির্মল সেনের বড় পরিচয় সাংবাদিক হলেও শৈশব-কৈশোর থেকেই ছিলেন রাজনীতি সচেতন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি প্রত্যক্ষভাবে সাধারণ মানুষের রাজনীতি করেছেন, দল গঠন করেছেন এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। সারাজীবন কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করেছেন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দলের সদস্য। এক সময় বামপন্থি প্রগতিশীল দলগুলোর মোর্চা গঠনে ভূমিকা রাখেন। `তার দলের ভেতরে ও বাইরে সবার কাছে তিনি রাজনীতি ও সাংবাদিকতা- উভয় ক্ষেত্রে তার নৈতিক মূল্যবোধের জন্য সমভাবে নন্দিত ও প্রশংসিত।`

 

রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতার পেশা বেছে নিয়েছিলেন আদর্শগত কারণে। পরম নিষ্ঠার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছেন। অসাধুতা কখনো তার কলমকে স্পর্শ করতে পারেনি। নীতি ও আদর্শ থেকে তিনি কখনো বিচ্যুত হননি। সারাজীবন ছিলেন অন্যায়-অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং সাহসিক ও নির্ভীক। `অনিকেত` এই ছদ্মনামে দৈনিক বাংলায় কলাম লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। তার একটি কলাম `স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই` বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণবঙ্গে গোর্কিতে স্বজনহারাদের নিয়ে প্রতিদিনের লেখাগুলো ঐ সময় মানুষের হৃদয়ে ভিষণভাবে দাগ কাটে এবং সাধারণ পাঠকের কাছে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। সংবাদ জগতের প্রতিটি মানুষের কাছে ছিলেন তিনি `নির্মলদা`।

 

বরিশালে পড়াশোনার সময় তার সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত গণবার্তায় খবর প্রেরণ করে যাত্রা শুরু। ১৯৫৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে চাকরি গ্রহণ। ১৯৬৩ সালে দৈনিক জেহাদে যোগদান। পরে আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমানের সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় যোগদান। পত্রিকাটির প্রথম ও প্রধান সম্পাদক ছিলেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী। ১৯৬৪ সালের ৬ অক্টোবর দৈনিক পাকিস্তান, পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় একটানা ৩৩ বছর সাংবাদিকতা করেন। প্রেস ট্রাস্টের এই পত্রিকাটি ১৯৯৭ সালে বন্ধ হওয়ার দিন পর্যন্ত নির্মল সেন এই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন।

 

১৯৭২-৭৩ সালে নির্মল সেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও ১৯৭২-৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ফেডালের সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের আজীবন সদস্য ছিলেন। এছাড়াও নির্মল সেন প্রায় ৮ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অতিথিশিক্ষক ছিলেন।

 

সাংবাদিক হিসাবে নির্মল সেন ভারত, জার্মান, রাশিয়া, হাঙ্গেরি, নেপাল, যুগোস্লোভিয়া, চেকোস্লোভেকিয়া ভ্রমণ করেন। রাজনীতিক হিসাবে ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, সুইজারল্যান্ড, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীনসহ বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। তার  ‘মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্র’, ‘বার্লিন থেকে মস্কো’, ‘পুর্ববঙ্গ-পূর্বপাকিস্তান-বাংলাদেশ’, ‘মা জন্মভূমি’, ‘লেনিন থেকে গর্ভাচেভ’, ‘আমার জবানবন্দী’, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ ও ‘আমার জীবনে ৭১-এর যুদ্ধ’ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

 

২০০৩ সলের ১১ অক্টোবর নির্মল সেন ব্রেইনস্ট্রোকে আক্রান্ত হন। তার জীবনের শেষ  ইচ্ছা নিজ বাড়িতে একটি মহিলা কলেজ স্থাপন করা। কলেজটির নামকরণ করা হয়েছে সাংবাদিক নির্মল সেন মহিলা কলেজ। জীবদ্দশাতেই তিনি কলেজটির জন্য তার বাড়ির ১ একর ৫০ শতক জায়গা রেজিস্ট্রি করে দিয়েছিলেন।

 

নির্মল সেন কয়েক দিন হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ২০১৩ সালের ৮ জানুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন। চিকিৎসাশাস্ত্রের উৎকর্ষে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতার জন্যে মৃত্যুর আগে তিনি নিজ দেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে যান।

 

জনগণের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিই মানুষের মুক্তি- এই আদর্শকেই তিনি ধারণ করেছেন আজীবন। কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের প্রতি ছিল তার অসীম দরদ। বাংলাদেশ তথা মাতৃভূমিকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন সৎ মানুষ।  তার আদর্শ প্রজন্মকে পথ দেখাবে এবং তিনি আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

       

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ আগস্ট ২০১৫/টিপু