সাতসতেরো

ফ্লপ থেকে মহানায়ক

বাবলু ভট্টাচার্যশুরুর সেই লড়াইটা ছিল ভয়ংকর, ফ্লপ এবং ফ্লপ। হাত থেকে কনট্রাক্টের কাগজ ছিনিয়ে নিয়েছেন প্রযোজক। মুখের ওপর বলে দিয়েছেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনার চেহারাটা নায়কোচিত নয়।’ তুলনাটা চলে আসত প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে। দ্বিতীয় প্রতিপক্ষও তখন নেপথ্যে দাঁড়িয়ে; সেই দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তার ‘মাচো-হিম্যান’ ইমেজে গত শতাব্দীর পঞ্চাশোর্ধ বাঙালিরা তখনও আত্মহারা। হৃদয়ের কুঠুরিতে লেখা হয়ে গেছে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা প্রমথেশ বড়ুয়া-এই দুই নাম। তাদের পাশে নবাগত উত্তম কুমার। ভাগ্যিস ‘বসু পরিবার’ (১৯৫২) বক্স অফিসের মুখ দেখেছিল। না হলে আজকের বাঙালি কোথায় পেত এই উত্তম কুমারকে? বঙ্কিম গ্রিবা, হৃদয়ে তোলপাড় করা হাসি আর অভিনয়ের চূড়ান্ত আধুনিকতা-এগুলোই উত্তমের সাফল্যের তাস।১৯৩৯ সাল। দেশজুড়ে তখন এক অশান্ত অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা। সেই উত্তপ্ত সময়ের মধ্যে কৈশোর পেরিয়ে যৌবন উত্তমের। একচল্লিশের ২২ শ্রাবণ। ১৫ বছরের অরুণ পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াল রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রায়, লক্ষ মানুষের মিছিলে। পরের বছরই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের উন্মাদনায় ভবানীপুরের অলিগলিতে বের হতো অরুণের নেতৃত্বে স্বদেশি প্রভাতফেরি। অরুণেরই লেখা গান তারই সুরে গাওয়া হতো। সে বছরই ম্যাট্রিক পরীক্ষা এবং পাস। ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন কলকাতার সাউথ সুবাবরণ মেইন স্কুল থেকে। এরপর ভর্তি হন গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে। এখানে পড়েন কমার্স নিয়ে। ১৯৪২ সালেই নিদান ব্যানার্জীর কাছে সঙ্গীতের তালিম নেন। ১৯৪৪ সালে পৌর কমিশনারস অফিসে খিদিরপুর ডকে ক্যাশিয়ারের চাকরি পান, ২ হাজার টাকা সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসেবে জমা দিয়ে। সে আরেক গল্প। যদিও ভাগ্যবিধাতা তার জন্য আরো অনেক গল্পই লিখে রেখেছিলেন। তাইতো ১৯৪৭ সালে প্রথম ভারত লক্ষ্মী স্টুডিওর ফ্লোরে আসেন উত্তম কুমার। প্রথম অভিনীত ছবি ‘মায়াডোর’ (হিন্দি) দিয়ে শুরু হয় চলচ্চিত্র যাত্রা। এ ছবিতে কাজ করে দৈনিক পাঁচ সিকি পেতেন। নায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন ‘কামনা’ ছবিতে (১৯৪৯)। নায়িকা ছিলেন ছবি রায়। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর ফ্লপ করে।

কলকাতার ভবানীপুর এলাকায় থাকতেন উত্তম কুমার। কাছাকাছি পাড়ায় সেকালের রূপবান নায়ক ধীরাজ ভট্টাচার্য, পুরনো ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, চরিত্রাভিনেতা ইন্দু মুখার্জি বাস করতেন। তাদের কাজ দেখে শিখেছেন উত্তম কুমার। আর তার সঙ্গে অবচেতন মনে ছিল দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথেশ বড়ুয়া, ছবি বিশ্বাস, জ্যোতি প্রকাশ, অসিতবরণ ও রবীন মজুমদারের মতো রোমান্টিক সব নায়কের রূপালি পর্দায় দেখার অদৃশ্য শিহরণ। সে জন্য তিনি ফিল্মে নায়ক হতে পেরেছিলেন। অভিনয়ের চেয়েও তখন তার বড় মূলধন ছিল চেহারা। অথচ উত্তম কুমার প্রথম দিকের কোনো ছবিতেই নায়কের ভূমিকা পাননি। শুধু মুখ দেখানো ছাড়া আর কোনো অস্তিত্বই ছিল না সেখানে তার। বরং বলা যায় অনুগ্রহের পাত্র হয়েই মাত্র উপস্থিত থেকেছেন সেসব ছবিতে। এখন হয়তো অনেক দর্শক মনেই করতে পারবেন না, ‘মায়াডোর’ (১৯৪৭), ‘দৃষ্টিদান’ (১৯৪৮), ‘কামনা’ (১৯৪৯),‘মর্যাদা’ (১৯৫০), ‘নষ্ট নীড়’ (১৯৫১), ‘সঞ্জীবনী’ (১৯৫২) প্রভৃতি ছবিতে উত্তম কুমার ছিলেন। এর মধ্যে একটি ছবিও ব্যবসাসফল হয়নি। যে জন্য উত্তম কুমার তখন দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবি দিয়েই উত্তম কুমারের জয়যাত্রা শুরু। নায়িকা সুচিত্রা সেন। যদিও এই জুটির শুরুটা হয়েছিল ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ দিয়ে। প্রায় ম্যাজিকের মতো ফল পাওয়া গেল এই ছবি থেকে। বাংলা ছবিতে যে ভাটার টান অনুভব করা যাচ্ছিল, সেই স্তিমিত জলে সহসা আবেগ সঞ্চার করল উত্তম-সুচিত্রা জুটি। বাংলা ছবিতে এলো গ্ল্যামার, দর্শকদের ভালো লাগার সঙ্গে যুক্ত হলো মুগ্ধতা। নায়ক থেকে মহানায়কের শীর্ষ আসনটিতে উত্তরণের সঠিক যাত্রারম্ভ হলো এই ‘অগ্নিপরীক্ষা’ থেকে। বাঙালি দর্শক সেদিন তাদের আইডিয়াল একজন রোমান্টিক হিরোকে খুঁজে পেলেন উত্তম কুমারের মধ্যে। যার বিকল্প তার জীবদ্দশায় আর আসেনি। নায়ককে ঘিরে যে মোহ বিস্তার, যে গুঞ্জরণ, যে কৌতূহল সবই শুরু হয়েছিল ১৯৫৪ সালের সেই সন্ধিক্ষণ থেকে।গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের প্রায় মধ্যভাগ থেকে উত্তম কুমার ক্রমেই দর্শক, প্রযোজক, পরিবেশক এবং পরিচালকদের দৃষ্টি কেড়ে নিতে লাগলেন। এভাবেই বক্স অফিসের নিশ্চিত গ্যারান্টিও হয়ে উঠলেন তিনি। তিনি শুধু বাংলা ছবির অন্যতম নায়কই নন, চরিত্রাভিনেতাও। বহু বাংলা ছবিকে ভরাডুবি থেকে আশ্চর্যজনকভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছেন শুধু উত্তম কুমার। শুধু প্রণয়ী নায়কের ভূমিকাতেই তিনি স্থিত থাকেননি, তিনি মদ্যপ জমিদার থেকে ছিঁচকে চোর- বহু ভূমিকাতেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন চরিত্রের মাপে।চলচ্চিত্রের নায়ক উত্তম কুমার পর্দার বাইরেও কিংবদন্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলেন আপামর জনসাধারণের মধ্যে। সাধারণ মধ্যবিত্ত মেয়েদের কাছে সুদর্শন পুরুষ অথবা রোমান্টিকতার সার্থক উদাহরণ ছিলেন উত্তম কুমার। নায়ক শব্দের আগে ‘মহা’ শব্দটি যোগ হয়েছিল ১৯৭০ সালের পর থেকে। এটার কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না, প্রয়োজনও পড়েনি। জনসাধারণের ভালোবাসা আর মুগ্ধতা থেকেই এই শব্দটি জন্ম নিয়েছিল। ক্রমেই উত্তম কুমারের নামের পাশে এই বিশেষণটি স্থায়ী হয়ে গেল। ১৯৬৬ সালে সত্যজিৎ রায় ‘নায়ক’ লিখেছিলেন উত্তম কুমারকে ভেবেই। এভাবে বাংলা সাহিত্যেও অনেক গল্প এবং উপন্যাস লেখা হয়েছে উত্তম কুমারের কথা মনে রেখেই।উত্তম কুমার মহানায়ক হিসেবে তিন দশক ধরে বাঙালি দর্শকদের মাতিয়ে রেখেছিলেন। এভাবে মাতিয়ে রেখে মোহাবিষ্ট করে রাখার ইতিহাসও একমাত্র এই উত্তম কুমারের। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো:‘পথে হলো দেরী’, ‘শিল্পী’, ‘সাগরিকা’, ‘হারানো সুর’, ‘সপ্তপদী’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘শহরের ইতিকথা’, ‘পৃথিবী আমারে চায়’ প্রভৃতি। এই ছবিগুলো যেন চিরকালের, চিরদিনের ছবি হয়ে থাকল।উত্তম কুমার ১৯২৬ সালের আজকের দিনে (৩ সেপ্টেম্বর) কলকাতার অহেরিটোলা স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন।